‘আই সি ওয়েভস’ যেভাবে হয়ে গেলো ‘রেহানা মরিয়ম নূর’

Share Now..

সিঙ্গাপুর চলচ্চিত্র উৎসবে ‘লাইভ ফ্রম ঢাকা’ সেরা পরিচালক ও সেরা অভিনেতার পুরস্কার জেতার পর আবদুল্লাহ মোহাম্মদ সাদ বানাতে চেয়েছিলেন ‘আই সি ওয়েভস’। নিজের প্রথম ছবির শেষ দৃশ্য সম্পাদনার সময় তিনি ভাবছিলেন, ঢাকা ছাড়তে মরিয়া সাজ্জাদের (লাইভ ফ্রম ঢাকার প্রধান চরিত্র) পরিণতি কী হবে? তখন অভিবাসনের বিষয়টি আসে তার মাথায়। তাই তিনি গল্প সাজিয়েছিলেন, একজন রাজনীতিবিদকে খুনের দায়ে ফাঁসি থেকে বাঁচতে ব্যাংককে পালায় সাজ্জাদ। অচেনা শহরে একজন মানুষের বেঁচে থাকার গল্পের মাধ্যমে অভিবাসীদের জটিল জীবনযাপন তুলে ধরার মনস্থির করেন এই তরুণ নির্মাতা।

সিঙ্গাপুর চলচ্চিত্র উৎসবে দেশটির প্রযোজক জেরেমি চুয়ার সঙ্গে আবদুল্লাহ মোহাম্মদ সাদের পরিচয় হয়। ‘আই সি ওয়েভস’-এর জন্য জোট বাঁধেন তারা। সহ-প্রযোজক হিসেবে যুক্ত হন রাজীব মহাজন। তিনি বুসান এশিয়ান ফিল্ম স্কুল থেকে আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র ব্যবসা বিষয়ে স্নাতক পড়েছেন।

২০১৪ সালে নিজের প্রতিষ্ঠান পোটোকল গড়ে তোলেন জেরেমি চুয়া। ২০১৬ সালে কান উৎসবের প্যারালাল বিভাগ ইন্টারন্যাশনাল ক্রিটিকস উইকে নির্বাচিত কে. রাজাগোপাল পরিচালিত ‘অ্যা ইয়েলো বার্ড’ সহ-প্রযোজনা করেন তিনি। একই বছর বার্লিনে আলফ্রেড বাউয়ার জয়ী লাব ডিয়াজের ‘অ্যা লুলাবি টু দ্য সরোফুল মিস্টারি’র প্রযোজক এই তরুণ।

২০১৭ সালে বুসান চলচ্চিত্র উৎসবের এশিয়ান সিনেমা ফান্ড থেকে পাণ্ডুলিপি উন্নয়নের জন্য ১০ হাজার মার্কিন ডলার (সাড়ে ৮ লাখ টাকা) পায় ‘আই সি ওয়েভস’। এরপর আবদুল্লাহ মোহাম্মদ সাদ, জেরেমি চুয়া ও রাজীব মহাজন ব্যাংকক যান। পরে তাদের সঙ্গে যোগ দেন চিত্রগ্রাহক তুহিন তমিজুল। কিন্তু সেখানে তারা ধীরে ধীরে বুঝতে পারেন, ঢাকায় বসে সাজানো চিত্রনাট্যের সঙ্গে ব্যাংককের অভিবাসীদের জীবনযাপনের মিল নেই। এ কারণে হতাশ হয়ে পড়েন সাদ। শেষ পর্যন্ত অন্য গল্প নিয়ে কাজ করার সিদ্ধান্ত নেন সবাই। কিন্তু নামটা ‘আই সি ওয়েভস’ই থেকে যায়।

বুসান চলচ্চিত্র উৎসবের এশিয়ান প্রজেক্ট মার্কেটে নির্বাচিত হয় ‘আই সি ওয়েভস’। ছবিটির গল্প মানসিক যন্ত্রণায় ভুগতে থাকা একজন মেডিকেল অধ্যাপককে কেন্দ্র করে এগিয়ে যায়। একটি যৌন নির্যাতনের সাক্ষী হওয়ার পর বদলে যায় তার জীবনবোধ।

কানের ৭৪তম আসরের আঁ সার্তে রিগায় নির্বাচিত ‘রেহানা মরিয়ম নূর’-এর গল্প যারা জানেন তাদের কাছে ‘আই সি ওয়েভস-এর গল্প একই মনে হচ্ছে না? মনে না হওয়ার কারণ নেই। গল্পটা একই। একটি বেসরকারি মেডিকেল কলেজের সহকারী অধ্যাপক রেহানা মরিয়ম নূরকে কেন্দ্র করেই এর গল্প। কর্মস্থলে ও পরিবারে তাল মেলাতে গিয়ে হিমশিম খেতে হয় তাকে। কারণ শিক্ষক, চিকিৎসক, বোন, কন্যা ও মা হিসেবে জটিল জীবনযাপন করেন তিনি।

এক সন্ধ্যায় একজন অধ্যাপকের কক্ষ থেকে এক ছাত্রীকে কাঁদতে কাঁদতে বের হতে দেখে রেহানা। এ ঘটনার পর ক্রমে একরোখা হয়ে ওঠেন তিনি। ওই ছাত্রীর পক্ষ হয়ে সহকর্মীর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে শুরু করে সে। কিন্তু একই সময়ে তার ছয় বছর বয়সী মেয়ের বিরুদ্ধে স্কুল থেকে রূঢ় আচরণের অভিযোগ ওঠে। অনড় রেহানা তথাকথিত নিয়মের বাইরে গিয়ে ভুক্তভোগী ছাত্রী ও নিজের মেয়ের জন্য ন্যায়বিচারের লড়াই করতে থাকে।
২০১৮ সালে আমেরিকান সংবাদমাধ্যম ভ্যারাইটিকে আবদুল্লাহ মোহাম্মদ সাদ বলেছিলেন, ‘আমার বেশ কয়েকজন বন্ধু বেসরকারি মেডিক্যাল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করেছে। তাদের কাছ থেকে অনেক গল্প শুনতাম। সেগুলোর মধ্যে কিছু গল্প আমার ভেতর রয়ে যেতো, বিশেষ করে একটি যৌন হেনস্তার ঘটনা।’তবে ৭৪তম কান চলচ্চিত্র উৎসবের অফিসিয়াল সিলেকশনে স্থান পেয়ে ইতিহাস গড়ার পর গণমাধ্যমে পাঠানো বিবৃতিতে আবদুল্লাহ মোহাম্মদ সাদ বলেন, ‘আমি মধ্যবিত্ত পরিবারে অনেক ভাইবোনের মাঝে বড় হয়েছি। আমার চিন্তাভাবনায় তাদের সবার অনেক প্রভাব। বিশেষ করে আমার তিন আপুর। সম্ভবত ওই রকম একটা জায়গা থেকে রেহানাকে নিয়ে লিখতে শুরু করি। একটু একটু করে রেহানাকে নিয়ে প্রশ্ন করতে শুরু করি। ওর ভেতরের ক্ষোভ আর অবিশ্বাস নিয়ে ভাবি। ওর ভেতরের কমপ্লেক্সিটি ও কন্ট্রাডিক্টরি আচরণ বোঝার চেষ্টা করি। রেহানা কী চায় এবং কেনো চায় তা নিয়ে লিখতে লিখতে ক্রমে আরো প্রশ্ন বের হতে শুরু করে। শেষ পর্যন্ত ওই প্রশ্নগুলোই আমাকে ছবিটি নির্মাণে অনুপ্রাণিত করে।আই সি ওয়েভস’ ছবির প্রাথমিক বাজেট ধরা হয়েছিলো ২ কোটি ১৩ লাখ টাকার মতো। জেরেমি চুয়ার প্রতিষ্ঠান পোটোকল ও বাংলাদেশের মেট্রো ভিডিওর ব্যানারে তৈরি হয়েছে ছবিটি। তাদের পরিকল্পনা ছিলো বাজেটের ৪০ শতাংশ ব্যক্তিপর্যায় থেকে এবং বাকি ৬০ শতাংশ বিভিন্ন ফান্ড থেকে সংগ্রহ করবেন। কিন্তু ব্যক্তিপর্যায় থেকে তারা একেবারেই কিছু পাননি বলা চলে। তাই ইউরোপিয়ান ফান্ড পাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *