ইরাক যুদ্ধে জড়িত ব্যক্তিরা এখন কোথায়
২০০৩ সালে প্রায় ২০ আগে শুরু হয়েছিল ইরাক যুদ্ধ। বিশ্বের মানুষের কাছে তখন পরিচিত নাম ছিল তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জজ ডাব্লিউ বুশ ও ইরাকি প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন। কিন্তু সেই যুদ্ধের সঙ্গে জড়িত ছিল আরও অনেক ব্যক্তি । খবর বিবিসি। ইরাক যুদ্ধে সাড়ে চার হাজারের বেশি মার্কিন সেনা আর আনুমানিক এক লাখ বিশ হাজার ইরাকি বেসামরিক মানুষ নিহত হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়। বিশ বছর পার হলেও এখনো পুরোপুরি স্থিতিশীলতা আসেনি ইরাকে।
যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ড. আলী রিয়াজ-এর মতে, ইরাক যুদ্ধে যারা উস্কানি দিয়েছিলেন, যারা মনে করেছিলেন যে, ইরাকের বিরুদ্ধে যুদ্ধটা করা দরকার, তারা ছিলেন ‘নিও কনজারভেটিভ।’
‘’তাদের উত্থান হয়েছিল নব্বুইয়ের দশক থেকে। তারা খুব জোরেশোরে চেষ্টা করছিলেন বিশ্বে নিজেদের একটা শক্তিমত্তা তুলে ধরার, ‘’ বলেন ড. রিয়াজ, যিনি বর্তমানে সুইডেনের ভ্যারাইটিস অফ ডেমোক্রেসি ইন্সটিটিউটের ভিজিটিং প্রফেসর।
‘’পরবর্তীতে রাজনৈতিকভাবে তারা এক অর্থে পরাজিত হয়েছে। তাদের আধিপত্য দেখানোর যে চিন্তাভাবনা, পরবর্তী পৃথিবীতে আর সেটা কাজ করেনি- না যুক্তরাষ্ট্রে, না বিশ্বে। পরবর্তীতে তারা নীতিনির্ধারণের অনেক বাইরে চলে গেছেন,’’ তিনি বলেন।
তিনি বলছেন, ইরাক যুদ্ধে বিপর্যস্ত হওয়া, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ- ইত্যাদি তাদের কোন সুবিধা দেয়নি। বরং রাজনৈতিকভাবে তাদের নানারকম সমস্যায় ফেলেছে।
ইরাক যুদ্ধের বিশ বছর পূর্তিতে বিবিসি জানার চেষ্টা করেছে, সেই যুদ্ধের পেছনে মূল ভূমিকা রাখা ব্যক্তিরা এখন কোথায় কেমন রয়েছে।
গণ বিধ্বংসী অস্ত্র
ইরাক যুদ্ধের মাত্র দুই বছর আগে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই নাইন ইলেভেনের মুখোমুখি হতে হয় জর্জ ওয়াকার বুশ বা জর্জ ডব্লিউ বুশকে। সেই সময় মিত্র দেশগুলোর সঙ্গে মিলে আফগানিস্তানে অভিযান চালিয়ে তালেবান সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করেন বুশ।
এর প্রায় দেড় বছরের মাথায় তিনি ইরাকে অভিযান শুরু করেন।
তার আগে ২০০২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বুশ প্রশাসন নতুন জাতীয় নিরাপত্তা নীতি ঘোষণা করে, যেখানে বলা হয় যে, জৈবিক, রাসায়নিক বা পারমাণবিক অস্ত্র, গণ বিধ্বংসী অস্ত্রের অধিকারী কোন সন্ত্রাসবাদী বা দুর্বৃত্ত দেশ দ্বারা যুক্তরাষ্ট্র যদি হুমকি মুখোমুখি হয়, তাহলে সেটা ঠেকানোর জন্য প্রয়োজনে সামরিক শক্তি ব্যবহার করবে।
দুই মাস পরেই যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ নতুন একটি প্রস্তাব গ্রহণ করে, যেখানে অস্ত্র পরিদর্শকদের ইরাকে ফিরে যাওয়ার সুযোগ রাখা হয়। কিছুদিন পরেই যুক্তরাষ্ট্র ঘোষণা করে, নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাবনা মানছে না ইরাক এবং তাদের ব্যাপক বিধ্বংসী অস্ত্র আছে।
অবশেষে মার্চের ১৭ তারিখে সাদ্দাম হোসেনকে পরিবার নিয়ে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ইরাক ছাড়ার সময়সীমা বেধে দেন প্রেসিডেন্ট বুশ। ৪৮ ঘণ্টা পরেই শুরু হয় অপারেশন ইরাকি ফ্রিডম।
জর্জ ডব্লিউ বুশ
পরবর্তীতে ইরাকে ব্যাপক বিধ্বংসী অস্ত্র না পাওয়া এবং ইরাক যুদ্ধ দীর্ঘমেয়াদি হয়ে ওঠায় ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েন প্রেসিডেন্ট বুশ।
ইরাক যুদ্ধ নিয়ে নানারকম বিতর্ক এবং সমালোচনা থাকার পরেও ডেমোক্রেটিক প্রার্থী জন কেরিকে হারিয়ে ২০০৪ সালের নির্বাচনে পুনরায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন বুশ।
তার মেয়াদ ২০০৯ সালে শেষ হওয়ার পর টেক্সাস অঙ্গরাজ্যে ফিরে যান বুশ। সেখানে তিনি জর্জ ডব্লিউ বুশ প্রেসিডেন্সিয়াল লাইব্রেরি তৈরি করেছেন। সেখানে জর্জ ডব্লিউ বুশ পলিসি ইন্সটিটিউট এবং অফিস অফ দি জর্জ ডব্লিউ বুশ ফাউন্ডেশন রয়েছে।
মার্কিন প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব ছাড়ার পর থেকে প্রকাশ্যে খুব একটা আসেননা মি. বুশ।
শয়তান’ সাদ্দাম হোসেন
ইরাক যুদ্ধের সময় যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন স্যার অ্যান্টনি চার্লস লিনটন ব্লেয়ার, যিনি টনি ব্লেয়ার নামেই বেশি পরিচিত।
ইরাক যুদ্ধ নিয়ে পরবর্তীতে স্যার জন শিলকটের তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘’২০০২ সালের ২৪শে সেপ্টেম্বর হাউজ অব কমন্সে টনি ব্লেয়ার ইরাকের অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যতে ব্যাপক বিধ্বংসী অস্ত্র তৈরির সক্ষমতার যে প্রতিবেদন তুলে ধরেন, সেখানে তাদের সম্ভাব্য হুমকি হিসাবে তুলে ধরা হয়। ভবিষ্যতের কোন একপর্যায়ে সেটা সত্যি হয়ে উঠতে পারে।‘’
শিলকট প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শান্তিপূর্ণভাবে ইরাককে নিরস্ত্র করার পদক্ষেপ বিবেচনা না করেই ব্রিটেন ইরাকের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়েছে।
তবে ওই প্রতিবেদনের সমালোচনা প্রত্যাখ্যান করে পরবর্তীতে টনি ব্লেয়ার একটি সংবাদ সম্মেলন করে বলেছিলেন, কোন অজুহাত না দিয়েই ইরাক যুদ্ধের পরিণতি তিনি মেনে নিয়েছেন।
কিন্তু তিনি চেয়েছিলেন, ‘শয়তান’ সাদ্দাম হোসেনের কবল থেকে যেন ইরাকের জনগণ মুক্তি পায় এবং কোনরকম জাতিগত সহিংসতার শিকার না হয়।
যুদ্ধে কিছু ভুলের জন্য তিনি দুঃখ, অনুশোচনা ও ক্ষমা চাইলেও তিনি মনে করেন, সাদ্দাম হোসেনকে অপসারণ করার সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল।
যুদ্ধের পরেও আরও চার বছর ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন টনি ব্লেয়ার। তিনি হলেন যুক্তরাজ্যে সবচেয়ে বেশি সময় ধরে এই পদে দায়িত্ব পালনকারী কোন ব্যক্তি।
টনি ব্লেয়ারের বিদায়
ইরাক যুদ্ধে সরকারের নীতি নিয়ে নানারকম সমালোচনার পরেও তার নেতৃত্বে ২০০৫ সালের মে মাসের সাধারণ নির্বাচনে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করে লেবার পার্টি।
তবে সেই সময় দলের ভেতর নানারকম সমালোচনা এবং বেশ কয়েকজন জুনিয়র মন্ত্রীর পদত্যাগের পর ২০০৬ সালের সেপ্টেম্বরে ঘোষণা করেন যে, তিনি এক বছরের মধ্যেই পদত্যাগ করবেন।