বিশ্ব শিক্ষক দিবস আজ
বেতন-ভাতা, মর্যাদা, পদোন্নতি, অবসর সুবিধাসহ সবক্ষেত্রেই তীব্র বৈষম্যের শিকার বেসরকারি শিক্ষকরা। একই শিক্ষাগত যোগ্যতায় নিয়োগ, একই কারিকুলামে পাঠদানে নিয়োজিত থাকার পরও এই সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষকদের মধ্যে এই বৈষম্যকে শিক্ষক নেতারা দেখছেন ‘পেশার অমর্যাদা’ হিসেবে। শিক্ষক নেতারা বলছেন, বৈষম্য থাকতে পারে কিন্তু ‘আকাশ-পাতাল’ বৈষম্য মানা যায় না। অথচ যুগ যুগ ধরে বিভিন্ন স্তরের শিক্ষকদের মধ্যে এ সব বৈষম্য মেনে নিতে তারা বাধ্য হচ্ছেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সমযোগ্যতায় চাকরি করলে আর সমপরিমাণ শ্রম দিলে বেতন-ভাতায় বৈষম্য সৃষ্টি করা কাম্য নয়। তাই জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০-এ শিক্ষকদের মধ্যে বৈষম্য কমিয়ে আনার কথা বলা হয়েছে। তবে বাস্তব চিত্র ঠিক উলটো।
বৈষম্য কমাতে বা শিক্ষকদের বেতনভাতা ও সুযোগ-সুবিধার জন্য সভা-সমাবেশ ও রাজপথে তাদের আন্দোলন করতে হচ্ছে। আন্দোলন করতে গিয়ে শিক্ষকদের নির্যাতন-লাঞ্ছনার শিকারও হতে হচ্ছে। এমনি প্রেক্ষাপটে আজ বিশ্ব শিক্ষক দিবস পালিত হচ্ছে। সরকারিভাবে বাংলাদেশে এ দিবসটি পালন করা না হলেও বিভিন্ন বেসরকারি শিক্ষক সংগঠনগুলো দিবসটি পালন করে। সভা, সমাবেশ, সেমিনার পালনের সময় বেসরকারি শিক্ষকরা তাদের দুঃখ-দুর্দশা তুলে ধরে বিভিন্ন দাবি জানান সরকারের কাছে। ১৯৯৫ সাল থেকেই দিবসটি পালিত হচ্ছে।
দেশের শিক্ষাব্যবস্থার ৯৭ শতাংশই বেসরকারি ব্যবস্থাপনানির্ভর। এর মধ্যে এমপিওভুক্ত প্রায় ২৮ হাজার, স্বীকৃতিপ্রাপ্ত এবং স্বীকৃতিবিহীন প্রায় ১০ হাজার নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানে এমপিওভুক্ত প্রায় ৫ লাখ । নন-এমপিও শিক্ষক কর্মরত আছেন ১ লাখ ।
তথ্য অনুযায়ী, সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকেন সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীরা। বেতন, পূর্ণাঙ্গ বাড়িভাড়া, চিকিত্সাভাতা, পদোন্নতি, পূর্ণাঙ্গ উত্সব ভাতা, বার্ষিক প্রবৃদ্ধি—এসব সুবিধা রয়েছে। আছে বদলির ব্যবস্থাও। আরো আছে অবসরের পর পরিপূর্ণ অবসর ভাতাসহ মাসিক পেনশনসহ নানা ধরনের সুবিধা।
অন্যদিকে বেসরকারি এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীরা স্কেলের মূল বেতন পান। বাকি সব ভাতা ও সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রে তারা পিছিয়ে আছেন। সরকারি শিক্ষকরা মূল বেতনের ৫০-৬০ শতাংশ বাড়িভাড়া পান। অন্যদিকে এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা মাত্র ১ হাজার টাকা বাড়িভাড়া ও ৫০০ টাকা চিকিত্সাভাতা পেয়ে থাকেন। উত্সব ভাতা হিসেবে পান মূল বেতনের মাত্র ২৫ ভাগ আর কর্মচারীরা ৫০ ভাগ অর্থ। অবসর ভাতা যা এককালীন পাওয়া কথা, তা পান অবসরে যাওয়ার চার বছর পর। এটুকুই।
আর ননএমপিও শিক্ষকরা সরকারি কোনো সুবিধাই পান না। প্রতিষ্ঠানের আয় থাকলে বেতন পান। আয় না থাকলে মাস শেষে শূন্য হাতে বাড়ি ফিরতে হয়। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকেই এমন শিক্ষক আছেন অন্তত ১ লাখ। হতাশায় আর অভাবের কষাঘাতে জর্জরিত হয়ে অনেক নন-এমপিওদের জীবন থমকে আছে। কিছু কিছু শিক্ষক বেতন পান। স্কুল কলেজের বেতন দিয়ে বর্তমান সময়ে সংসার চালানো যায় না। মাসের মাঝামাঝি গিয়েই ধার আর দোকানে বাকি নিতে হয়।
বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের চাকরির ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের ইচ্ছার ওপর নির্ভর করতে হয়। কর্তৃপক্ষের ব্যবসায়িক লাভ-লোকসান, ইচ্ছা-অনিচ্ছায় এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের নিয়োগ ও চাকরিচ্যুত করা হয়। করোনাকালে এসব শিক্ষকের বঞ্চনা আরো বেড়ে যায়। অনেক শিক্ষকের বেতনভাতা কমিয়ে দেওয়া হয়। অনেককে বিনা বেতনে ছুটি দেওয়া হয়। আবার চাকরিচ্যুতও করা হয়েছে অনেককে।
অন্যদিকে বেশির ভাগ কিন্ডারগার্টেনের শিক্ষক মাসে ৫ হাজার, কোথাও ২ হাজার বা বেতন ছাড়াই নিয়োগ পান। প্রাইভেট টিউশনির আশায় কম বেতনে বা বিনা বেতনে শিক্ষাকতা পেশায় নাম লেখান অনেকে। কিন্তু করোনায় এবার তারা টের পেল এভাবে আর চলবে না। তাই কিন্ডারগার্টেনের অধিকাংশ শিক্ষকই পেশা বদলেছেন।
আর বেসরকারি অনার্স মাস্টার্স শিক্ষকদের চিত্রও একই। সরকারি সুবিধা ছাড়াই রয়েছেন ২৬ বছর। খুব কম প্রতিষ্ঠানই এই স্তরের শিক্ষকদের নিজ আয় থেকে বেতন দেন। ফলে শুধু আর্থিকভাবে নয়, সামাজিকভাবেও পিছিয়ে আছেন এই স্তরের শিক্ষকরা।
বাংলাদেশ অধ্যক্ষ পরিষদের সভাপতি অধ্যক্ষ মোহাম্মদ মাজহারুল হান্নান বলেন, ১৯৭১-এর স্বাধীনতা অর্জনের পরেও চলমান ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশে সরকারি ও বেসরকারি দুটি ধারায় বৈষম্যমূলক শিক্ষাব্যবস্থা চলতে থাকে এবং তা সম্প্রসারিত হতে থাকে। যদিও একটি স্বাধীন দেশে কোনোক্রমেই এ ধরনের বৈষম্য থাকা উচিত নয়।