‘খুব কষ্ট হচ্ছে, বাঁচব না’

Share Now..


একুশে ফেব্রুয়ারির দিন বেলা প্রায় ২টা পর্যন্ত মিছিল করে ছাত্ররা বীরত্বের সঙ্গে গ্রেফতার বরণ করতে থাকে। তখন ধীরে ধীরে ছাত্ররা মেডিক্যাল কলেজ হোস্টেলে, মেডিক্যাল কলেজ ও ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ গেটে জমা হতে থাকে। দলবদ্ধ হয়ে স্লোগান দিয়ে ছাত্রছাত্রীরা ১৪৪ ধারা লঙ্ঘন করে পথে বেরিয়ে এলে এবং প্রাদেশিক পরিষদ ভবনের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করলে পুলিশ যখন তাদের ওপর প্রচণ্ড কাঁদানে গ্যাস প্রয়োগ, বেপরোয়া লাঠিচার্জ ও পাইকারি গ্রেফতার শুরু করে। তখন মেডিক্যাল কলেজের ওয়ার্ড বয়, বেয়ারা, মেডিক্যাল হোস্টেল-সংলগ্ন রাস্তার পাশে রেস্টুরেন্টের বয়-বেয়ারা, পথচারী, রিকশাওয়ালা প্রমুখ তাদের সঙ্গে যোগদান করেন। এ সময় এমএলএ ও মন্ত্রীরা মেডিক্যাল কলেজের সামনে দিয়ে পরিষদে আসতে থাকেন। ছাত্ররা যতই স্লোগান দেয় আর মিছিলে একত্রিত হয়, পুলিশ ততই হানা দেয়। কয়েক বার ছাত্রদের ওপর কাঁদানে গ্যাস ছুড়ে তাড়া করতে করতে মেডিক্যাল কলেজ হোস্টেলের ভেতর ঢুকে পড়ে। হোস্টেল প্রাঙ্গণে ঢুকে ছাত্রদের ওপর আক্রমণ করায় ছাত্ররা বাধ্য হয় ইটপাটকেল ছুড়তে। পুলিশ তখন দিগ্বিদিক শূন্য হয়ে ছাত্রদের ওপর গুলি চালায়।আবুল বরকতের গুলি খাওয়া সম্পর্কে শামসুল বারী (মিঞা মোহন) বলেছেন, ‘সিগারেট ধরিয়ে ২০ নম্বর ব্যারাকের মাঝামাঝি কামরার বারান্দায় দাঁড়িয়ে জিরোচ্ছিলাম। আমার দিকে এগিয়ে এলেন বরকত, ডাকনাম, আবাই। আমাকে দেখে এগিয়ে এলেন তিনি, কিন্তু পড়ে গেলেন সঙ্গে সঙ্গে আমার হাত খানেক দূরে। পুলিশ ঢুকে পূর্ব দিক থেকে সোজা গুলি ছুড়ছে। সফিকুর রহমান ১৭ নম্বরে থাকতেন, দৌড়ে এসে পানি ঢেলে দিলেন, ভেবেছিলেন টিয়ার গ্যাসের প্রতিক্রিয়া। আমি গুলির কথা বললাম, ততক্ষণে পানির সঙ্গে রক্ত দেখা দিয়েছে বারান্দার মেঝেতে। তলপেটে লেগেছে গুলি। গায়ে ছিল তার নীল রঙের ফ্লাইং হাফ শার্ট, পরনে খাকি প্যান্ট, পায়ে কাবুলি স্যান্ডেল। তখন তার দুই ঠ্যাং সফিকুর রহমান কাঁধে তুলে নিলেন আর মাথা নিলাম আমার কাঁধে।…আমার কাছে পানি চাইল, কিন্তু কোথায় পানি, সময় নাই, পুলিশ দেখলে কেড়ে নিতে পারে, তাই পড়িমরি করে ছুটছি। ভেজা রুমালটা দিলাম চুষতে। …সে বল্ল, ‘খুব কষ্ট হচ্ছে, বাঁচব না, বিষ্ণুপ্রিয়া ভবন, পুরানা পল্টনে সংবাদ পৌঁছে দেন।’ তাকে নিয়ে ইমার্জেন্সি ওয়ার্ডে নামলাম। কেউ কেউ কেঁদে ফেলল। একজন নার্স ‘কাপুরুষ’ বলে গালাগালি দিয়ে প্রতিশোধ নেবার জন্য গেটে যেতে বল্লেন। আমি দরজার দিকে ঘুরে দাঁড়াতেই স্ট্রেচারে করে একজনকে মৃতদেহ আনতে দেখলাম। মাথার খুলি উড়ে গেছে। নিচের দিকে খানিকটা ঘিলু ঝুলছে। শুধু দাঁতগুলো দিয়ে হাসছে যেন আমাদের দিকে তাকিয়ে।…’

এম আর আখতার মুকুল সেদিনের ঘটনা প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘বেলা ৩টা ১০ মিনিটের সময় আকস্মিকভাবে একদল সশস্ত্র পুলিশ মেডিক্যাল কলেজ হোস্টেলের মধ্যে প্রবেশ করে এবং গুলিবর্ষণ করে। ঘটনাস্হলে জব্বার ও রফিকউদ্দীন নিহত হন। প্রকাশ্য রাস্তার ওপর পড়ে থাকা গোটা দুয়েক লাশ পুলিশ নিজেদের ট্রাকে নিয়ে যায়।’

মোহাম্মদ সুলতান বলেছেন, ‘কত রাউন্ড গুলি চলেছিল জানা যায়নি।…শহিদ হলেন একজন রিকশাচালক। শহিদ হলেন বরকত, জব্বার, সালাউদ্দিন প্রমুখ। বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠে বা রাস্তায় যারা শহিদ হলেন পুলিশি বাহিনী সঙ্গে সঙ্গে তাদের নিয়ে গাড়িতে তুললেন।…১৪৪ ধারা আর রইল না। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ ছাত্রবাস মহান তীর্থস্থানে পরিণত হলো। এ ঘটনায় ঢাকার সমস্ত অফিস-আদালত, কল-কারখানা, রেডিও, রেলগাড়ির চাকা বন্ধ হয়ে গেল। রিকশা চলাচল বন্ধ হয়ে গেল। হাজার হাজার লোক মেডিক্যাল কলেজে এসে জমা হতে থাকলেন। কান্নার রোল পড়ে গেছে চতু‌র্দিকে। পুলিশ বাহিনী সরে পড়েছে। ঢাকার রাস্তায় কোথাও একটি পুলিশ নেই।’

সত্যিই রক্তের স্রোত এক ফুঁয়ে উড়িয়ে নিয়ে গিয়েছিল সরকারের সমস্ত ব্যারিকেড। একুশে ফেব্রুয়ারি ঠিক কতজন মারা যান তা জানার আজ আর উপায় নেই। পুলিশ অনেক লাশ সরিয়েছে। এ কথা ভাষাসৈনিকদের কথায় উঠে এসেছে। কিন্তু জানা-অজানা বীর শহিদদের জীবনদান সারা দেশে ছড়িয়ে দিয়েছিল বিদ্রোহের আগুন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *