চলচ্চিত্রের উজ্জ্বল ‘মানিক’ সত্যজিৎ রায়

Share Now..

বাংলা চলচ্চিত্রের অন্যতম পরিচালক সত্যজিৎ রায়। কিংবদন্তী এ নির্মাতার হাত ধরে বাংলা সিনেমা প্রথমবারের মতো বিশ্ব দরবারে পৌঁছেছিল। চলচ্চিত্র নির্মানের পাশাপাশি লেখক, চিত্রনাট্যকার, সঙ্গীত পরিচালক এবং শিল্প নির্দেশক হিসেবেও তিনি খ্যাতি অর্জন করেছেন। আধুনিক বাংলা সংস্কৃতি জগতের বিরল প্রতিভাবান এই ব্যক্তিত্বের আজ (২ মে) ১০৩ তম জন্মবার্ষিকী। 

১৯২১ সালের ২ মে কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন সত্যজিৎ রায়। তার ডাক নাম মানিক। সত্যজিৎ-এর পিতা ছিলেন সুকুমার রায় চৌধুরী ।

সুকুমার রায় ছিলেন  শিশুসাহিত্যিক ও ভারতীয় সাহিত্যে ‘ননসেন্স ছড়া’ র প্রবর্তক। তিনি একাধারে লেখক, ছড়াকার, শিশুসাহিত্যিক, রম্যরচনাকার, প্রাবন্ধিক, নাট্যকার ও সম্পাদক। তার মায়ের নাম সুপ্রভা রায়।  সত্যজিৎের পরিবারের আদি নিবাস ছিল বাংলাদেশে।

৪০ বছরের চলচ্চিত্র ক্যারিয়ারে ৩৬টি চলচ্চিত্র পরিচালনা করেছিলেন সত্যজিৎ রায়, যার মধ্যে ফিচার ফিল্ম, ডকুমেন্টারি এবং শর্ট ফিল্ম রয়েছে। সত্যজিৎ রায়ের প্রথম ছবি হল ‘পথের পাঁচালী’, যা মুক্তি পায় ১৯৫৫ সালে, ছবিটি জিতেছিল ১১টি আন্তর্জাতিক পুরস্কার। সিনেমায় বিশেষ অবদানের জন্য সত্যজিৎ পেয়েছেন অস্কারের আজীবন সম্মাননা।  

ব্রিটিশ ম্যাগাজিন ‘সাইট অ্যান্ড সাউন্ড’-এর ১৯টি সেরা চলচ্চিত্রের মধ্যে ছিল পথের পাঁচালী। এই ছবিটি তৈরি করার সময় কেউ টাকা দিতে রাজি ছিলেন না।

জানা গিয়েছে, সত্যজিৎ রায় বন্ধুদের কাছ থেকে টাকা ধার করে তৈরি করেছিলেন পথের পাঁচালী। এমনকি এই চলচ্চিত্রের জন্য তাকে তার স্ত্রীর গহনা বন্ধক রাখতে হয়। নানা প্রতিকূলতার মধ্যে নির্মিত পথের পাঁচালী এতটাই সাফল্য পায় যে তা নিয়ে গোটা বিশ্বে আলোচনা হয়।

পথের পাঁচালীর পর সত্যজিৎ রায় ‘জলসাগর’, ‘মহাসাগর’, ‘অপরাজিতা’, ‘পরস পাথর’, ‘অপুর সংসার’, ‘চারুলতা’-এর মতো বহু বাংলা ও হিন্দি ছবি তৈরি করেন। সত্যজিৎ রায় ৩৬টি জাতীয় পুরস্কার জিতেছিলেন, যার মধ্যে ৬টি সেরা পরিচালকের জন্য এবং ৩০টি সেরা ফিচার ফিল্মের জন্য ছিল। 

১৯৮৮ সালে, ফ্রান্সের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি, সত্যজিৎ রায়কে ফ্রান্সের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান ‘লিজিয়ন অফ অনার’ দিয়ে সম্মানিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। সেই সময় সত্যজিৎ রায় অসুস্থ থাকার কারণে, তিনি নিজে কলকাতায় এসে এই সম্মান প্রদান করেন তাকে।

সত্যজিৎ রায় সম্পর্কে অস্কারজয়ী বিখ্যাত জাপানি চলচ্চিত্র নির্মাতা আকিরা কুরোসাওয়া বলেছিলেন, ‘রায়ের চলচ্চিত্র না দেখার বিষয়টি এমন যে, আপনি পৃথিবীতে বসবাস করছেন, অথচ সূর্য বা চাঁদ দেখেনি।’ 

জানা যায়, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছোট সত্যজিতকে অটোগ্রাফ দিয়েছিলেন। রবি ঠাকুরের অটোগ্রাফের খাতা হাতে পেতেই সত্যজিৎ তা খুলে দেখতে পান সেখানে কোনও সই নয়, বরং রয়েছে আস্ত একটি কবিতা। 

সেখানে লেখা ছিল, বহুদিন ধরে বহু ক্রোশ দূরে/বহু ব্যয় করি বহু দেশ ঘুরে/দেখিতে গিয়াছি পর্বত মালা/ দেখিতে গিয়াছি সিন্ধু। দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া/ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া/একটি ধানের শীষের উপর/ একটি শিশির বিন্দু।

কুরোসাওয়াকে সর্বকালের সেরা চলচ্চিত্র নির্মাতাদের একজন বলে বিবেচনা করা হয়। আর স্বনামধন্য এ নির্মাতাই বিভিন্ন সময় দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন যে, তিনি সত্যজিৎ রায়ের চলচ্চিত্রের ‘একজন ভক্ত’।

ফরাসি চলচ্চিত্র নির্মাতা জিন রেনোয়ারের সঙ্গে দেখা করার পর চলচ্চিত্রের প্রতি আগ্রহ আরও বেড়ে যায় সত্যজিৎ রায়ের। মধ্যবয়সে ছবি বানানো শুরু করা ‍সত্যজিৎ রায়ের জনপ্রিয়তার বিস্তার ঘটেছে যে, বিবিসি’র চালানো ‘সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি’ জরিপেও তার নাম উঠে এসেছে। 

জীবদ্দশায় মোট ৩২টি কাহিনীচিত্র এবং চারটি তথ্যচিত্র নির্মাণ করেছেন তিনি। মার্টিন স্কোরসেস থেকে শুরু করে খ্যাতনামা বহু পরিচালক তার সিনেমা দেখে চলচ্চিত্র নির্মাণে উৎসাহ পেয়েছেন বলে জানা যায়।

এগুলোর মাধ্যমে কান, বার্লিনসহ বিশ্ব চলচ্চিত্রের বড় বড় উৎসবে পেয়েছেন ডাক, ভূষিত হয়েছেন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অসংখ্য পুরস্কারে। এমনকি, চলচ্চিত্রে অবদানের জন্য ১৯৯২ সালের অস্কার আসরে সত্যজিৎ রায়কে আজীবন সম্মাননা প্রদান করা হয়।

এছাড়া সত্যজিৎ রায় পেয়েছিলেন দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার’। 

সত্যজিৎ রায় বাংলা সাহিত্যেও অবদান রেখে গেছেন। তার সৃষ্ট বিখ্যাত চরিত্র হলো- গোয়েন্দা ফেলুদা, বৈজ্ঞানিক প্রফেসর শঙ্কু ও তারিনীখুড়ো। তিনি এই তিনটি চরিত্র ছড়াও অনেক ছোটউপন্যাস ও ছোটগল্প রচনা করেছেন।

১৯৯২ সালের ২৩ এপ্রিল এই মহান চলচ্চিত্রকার মৃত্যুবরণ করেন। ১৯৯২ সালের ২৩ এপ্রিল মৃত্যু হয় সত্যজিৎ রায়ের, এরপর ওই বছরেই তাকে ‘ভারত রত্ন’ প্রদান করে ভারত সরকার।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *