চীন থেকে নির্বাসিত, উত্তর কোরিয়ায় নির্যাতিত

Share Now..

২৫ বছর চীনে বসবাসের পর এক উত্তর কোরীয় নারীকে স্বদেশে ফেরত পাঠানো হয়। এরপর তার আর কোনো সন্ধান মেলেনি। জোর করে ফেরত পাঠানো এমন উত্তর কোরীয়দের ভাগ্যে কী থাকে? ৯ অক্টোবর কিম চিওল ওকে নামের এক নারী উত্তর কোরিয়ায় তাকে ফেরত পাঠানোর আগে বিষয়টি পরিবারকে ফোনে জানাতে পেরেছিলেন।

চিওল ওকেসহ চীনে বসবাসকারী ৫০০ উত্তর কোরিয়ানকে জোরপূর্বক প্রত্যাবাসন করা হয়েছিল সেদিন। তার বড় বোন কিম কিউ লি থাকেন লন্ডনে। তিনি ১৯৯০ এর দশকের মহাদুর্ভিক্ষের সময় উত্তর কোরিয়া থেকে পালাতে পেরেছিলেন। তবে বোনের জীবনে কী হয়েছে, সেটি নিয়ে তিনি আতঙ্কিত।

ডয়চে ভেলেকে কিউ লি বলেন, ‘আমি নিশ্চিত যে, তাকে মারধর করা হচ্ছে।’ উত্তর কোরিয়ায় বন্দিরা প্রায়ই অনাহারে এবং অপুষ্টিজনিত অসুস্থতায় মারা যায়। কিউ লি বলেন, ‘তারা ইঁদুর ও তেলাপোকা খায় এবং এ কারণে অসুস্থ হয়ে পড়ে।’

গ্রাম থেকে কারাগারে

মাত্র ১৪ বছর বয়সে যখন চিওল ওকে চীনে পৌঁছেছিলেন তখন একজন পাচারকারীর মাধ্যমে ৩০ বছরের বড় এক ব্যক্তির সঙ্গে তার বিয়ে হয়েছিল। তাদের মেয়ে চীনা নাগরিকত্ব পেয়েছেন।

কিন্তু চিওল ওকে কখনই চীনা বসবাসের অনুমতি পাননি। ২৫ বছর ধরে চীনের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় জিলিন প্রদেশের একটি গ্রামীণ এলাকায় নির্জনে বসবাস করতেন। শুরুতে ক্ষেতে এবং পরে রেস্টুরেন্টে কাজ করতেন তিনি। কিউ লির জানিয়েছেন চিওল ওকের স্বামী তার সঙ্গে ভাল আচরণই করতেন।

কিন্তুএই বছরের শুরুতে সব বদলে যায়। ২০২৩ সালের এপ্রিলে তাকে চীনা পুলিশ গ্রেপ্তার করে। সম্ভবত চীন ছেড়ে যাওয়ার চেষ্টা করার সময় তিনি আটক হন। কিউ লি বলেন, ‘সে কিছুই করেনি। তার একমাত্র অপরাধ ছিল যে সে উত্তর কোরিয়ায় জন্মগ্রহণ করেছিল।’

পুরোনো ভীতি

কিউ লি এর পাশাপাশি চিওল ওকে এর আরেক বড় বোন কিম ইউ বিনও এখন লন্ডনে থাকেন। ইংল্যান্ডে পালিয়ে আসার আগে কিম ইউ বিনকে একবার চীন থেকে উত্তর কোরিয়ায় ফেরত পাঠানো হয়েছিল। যে অত্যাচার এবং দুর্ব্যবহারের শিকার তিনি হয়েছিলেন, সে স্মৃতি তাকে আজও তাড়া করে।

ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘আমার বোনকে গ্রেপ্তার করার পর থেকে আমি ভয়ানক দুঃস্বপ্ন দেখছি।’

ইউ বিন জানান, তার ভাই উত্তর কোরিয়ার নিরাপত্তা বাহিনীর হেফাজতে মারা গিয়েছিল। তার যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যুর বিবরণ পরে জানা গেছে পালাতে সক্ষম হওয়া সহবন্দিদের জবানবন্দিতে।

ইউ বিন বলেন, ‘তাকে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়েছিল। তারপর চালের বস্তায় ভরে ফেলে দেওয়া হয়েছিল। এই ঘটনা আমার হৃদয় ভেঙ্গে দিয়েছে।’

পরিবারের সবচেয়ে বড় ভয় হলো চিওল ওকেও একই রকম পরিণতির মুখোমুখি হতে পারেন। উত্তর কোরিয়া থেকে দক্ষিণ কোরিয়ায় পালিয়ে যাওয়া কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলেছে ডিডাব্লিউ। তাদের প্রত্যেককেই চীন থেকে উত্তর কোরিয়ায় ফেরত পাঠানো হয়েছিল। তারা জানিয়েছেন আটক অবস্থায় তাদের সঙ্গে অমানবিক আচরণ করা হয়েছিল।

৫০ বছর বয়সি লি ইয়ং জু দক্ষিণ কোরিয়ায় তার বাড়ি থেকে ভিডিও সাক্ষাত্কারে দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের সঙ্গে এমন আচরণ করা হয়েছিল যেন আমাদের অবস্থান পশুর চেয়ে নীচে।’

জিজ্ঞাসাবাদে তাকে নিয়মিত মারধর করা হতো বলে জানিয়েছেন ইয়ং জু। তিনি বলেন, ‘কোনো প্রশ্নের উত্তর দিতে এক সেকেন্ড ইতস্তত করলেও তারা আমাকে নির্যাতন করার জন্য লাঠিসোটা নিয়ে প্রস্তুত হতো। আমার মাথা ও মুখসহ সব জায়গাতেই মারধর করা হয়েছিল।’

‘রাজনৈতিক অপরাধী’

কোরিয়া ফিউচার এক হাজারের বেশি প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষাৎকার নিয়েছে। সংগঠনটি উত্তর কোরিয়ার শাস্তি ব্যবস্থায় মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ নথিভুক্ত করে। যেসব উত্তর কোরীয়কে দেশ থেকে পালানোর পর আবার ফেরত আনা হয়েছে তাদের একটি নৃশংস জিজ্ঞাসাবাদ প্রক্রিয়ার মুখোমুখি হতে হয়।

তারা কি দারিদ্র্য থেকে বাঁচতে পালিয়েছিল, নাকি তারা দক্ষিণ কোরিয়ায় যাওয়ার চেষ্টা করেছিল? দক্ষিণ কোরিয়াকে চিরশত্রু বিবেচনা করায় দ্বিতীয়টিকে জঘন্য অপরাধ হিসাবে বিবেচনা করে উত্তর কোরিয়া।

ডিডাব্লিউ-এর তদন্তকারী ইউনিট জানতে পেরেছে, দলত্যাগী কূটনীতিক এবং একসময় যেসব হ্যাকার চীনে ছিল, তাদেরও খুঁজে বের করে পিয়ংইয়ং।

কোরিয়া ফিউচার এর ইয়ু সুইয়ন বলেন, ‘অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক যেকোনো অপরাধীকেই নির্যাতনের সম্মুখীন হতে হয়। প্রতিদিন ১২ ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে তাদের আড়াআড়ি বসে থাকতে বাধ্য করা হয়। নড়াচড়া বা শব্দ করলে ফলে ব্যক্তিগত বা সম্মিলিত শাস্তি দেওয়া হয়।’

গুরুত্ব দিচ্ছে না বেইজিং

উত্তর কোরিয়ায় নির্যাতনের একাধিক তথ্য জানা সত্ত্বেও উত্তর কোরীয়দের নিজ দেশে প্রত্যাবাসন অব্যাহত রেখেছে চীন।

চিওল ওকের পক্ষে জাতিসংঘে একটি পিটিশন দাখিল করেছে ট্রানজিশনাল জাস্টিস ওয়ার্কিং গ্রুপ। প্রতিষ্ঠানটির আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞ ইথান হি-সিওক শিন বলেন, ‘শরণার্থী কনভেনশন এবং প্রোটোকলের পাশাপাশি নির্যাতন কনভেনশন দুটোই মানার ব্যাপারে বাধ্যবাধকতা রয়েছে চীনের। তারা নির্যাতনের সম্মুখীন হয় এমন মানুষদের নিজ দেশে ফেরত পাঠাতে পারে না।’

এই বছরের শুরুর দিকে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাই কমিশনের কর্মকর্তা পিয়ংইয়ংয়ের ঘনিষ্ঠ মিত্র চীনকে উত্তর কোরিয়ানদের জোরপূর্বক প্রত্যাবাসন বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছিল। সংস্থাটি বলেছিল, এমন ঘটনা ‘তাদের নির্বিচারে আটক, নির্যাতন, জোরপূর্বক গুম এবং বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের মতো গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঝুঁকিতে ফেলতে পারে।’

কিন্তু বেইজিং এই অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে বলেছে, ‘বর্তমানে উত্তর কোরিয়ায় নির্যাতন বা তথাকথিত ‘ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘনের’ কোনো প্রমাণ নেই।’

চীন উত্তর কোরিয়ানদের শরণার্থী নয়, বরং অনিয়মিত অর্থনৈতিক অভিবাসী হিসাবে বিবেচনা করে এবং জেনেভা শরণার্থী কনভেনশন এর অধীনে তাদের সুরক্ষা নিশ্চিতের বিষয়টি অস্বীকার করে।

ডিডাব্লিউ এ বিষয়ে চীন ও উত্তর কোরিয়া দুই সরকারের কাছেই মন্তব্য জানতে চেয়েছে। চীনের পক্ষ থেকে কোনো প্রতিক্রিয়া জানা যায়নি। তবে বার্লিনে উত্তর কোরিয়ার দূতাবাস একটি সংক্ষিপ্ত লিখিত বিবৃতিতে অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে এগুলোকে ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও শত্রু শক্তির’ বিভ্রান্তিকর প্রচার’ হিসেবে মন্তব্য করেছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *