চুয়াডাঙ্গায় কলাগাছের সুতায় তৈরি পণ্য যাচ্ছে বিদেশে

Share Now..

চুয়াডাঙ্গা প্রতিনিধি:
চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা উপজেলার পাটাচোরা গ্রামে পরিত্যক্ত কলাগাছের বাকল থেকে উৎপন্ন সুতা দিয়ে তৈরি করা হচ্ছে বিভিন্ন পণ্য। পরিত্যক্ত কলা গাছের আঁশযুক্ত সুতার তৈরি পণ্যে স্বপ্ন দেখছেন ওই গ্রামের বেকার নারী-পুরুষরা। ওই গ্রামে কলাগাছের সুতাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে একটি ক্ষুদ্র কুটিরশিল্পও।

কলাগাছের বাকল থেকে উৎপন্ন সুতা দিয়ে নৌকা, ওয়াল ম্যাট, ফুলদানি, শিকে, ক্যাপ, হ্যারিকেন, পাপোস, টেবিলম্যাট ও বাজারের ব্যাগসহ বিভিন্ন ধরনের পরিবেশ বান্ধব পণ্য তৈরি করছেন কৃষি উদ্যোক্তা শাহিন আলী। ইতোমধ্যে ওই সকল পণ্য মানুষের নজর কাড়তে শুরু করেছে। কলা গাছের আঁশযুক্ত সুতায় তৈরি পণ্যগুলো ইতোমধ্যে বিভিন্ন সরকারি দফতরসহ বাসা বাড়িতেও শোভা পাচ্ছে। তৈরি পণ্যগুলো শুধু দেশের বাজারে নয়, বিদেশেও রফতানি করছেন তিনি। ওই গ্রামের শতাধিক নারী পুরুষ এ শিল্পে নিয়োজিত হয়েছেন। তারা চেষ্টা করছেন তাদের ভাগ্যের চাকা ঘুরাতে। স্বপ্ন দেখছেন আগামীর। এর মধ্যেই প্রশিক্ষিতদের নিয়ে গঠন করা হয়েছে একটি সমিতি।

চুয়াডাঙ্গা জেলা শহর থেকে ১৬ কিলোমিটার ও দামুড়হুদা উপজেলা শহর থেকে সাত কিলোমিটার দূরে পাটাচোরা গ্রাম। এ গ্রামের যুবক শাহিন আলীর ছোটবেলা থেকেই পরিবেশ বান্ধব পণ্য ব্যবহারের প্রতি তার আগ্রহ ছিলো। প্রায় দু’বছর আগে সোশ্যাল মিডিয়াতে একটি ভিডিও দেখে সেখান থেকে শাহিন আলী কলাগাছ থেকে সুতা তৈরির বিষয়ে অবগত হন। মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করে কিনে আনেন সুতা তৈরির মেশিন। এরপর গ্রামের কলাক্ষেত থেকে পরিত্যক্ত কলাগাছের বাকল বা ছাল সংগ্রহ করেন তিনি। পরে সেই বাকল/ ছাল গুলো মেশিনে দিয়ে সুতা বের করেন। বেশ কিছুদিন সুতা তৈরি করার পর তার মাথায় আসে এ সুতা দিয়ে পণ্য তৈরি করার চিন্তা। পরবর্তীতে কলাগাছের বাকলের তৈরি সুতা পানিতে ধুয়ে রোদে শুকিয়ে বিভিন্ন ধরনের পণ্য তৈরি শুরু করেন তিনি। সুতা তৈরি শেষে কলা গাছের বর্জ্য থেকে ভার্মি ক¤েপাস্ট সারও তৈরি করেন তিনি।

প্রথমে বাড়ির মেয়েদের নিয়ে শুরু করেন পণ্য তৈরি। পরে আস্তে আস্তে গ্রামের অন্য নারী পুরুষদেরকেও যোগ করা হয় এ পেশায়। বর্তমানে এ কাজের সঙ্গে যুক্ত করেছেন ওই গ্রামের ছাত্রী, বিধবা, স্বামী পরিত্যক্তা, প্রতিবন্ধীসহ শতাধিক নারীকে। এ পেশার নারী পুরুষরা বিভিন্ন পণ্য তৈরি করে তারা একত্রে জমা করেন সমিতিতে। সেখান থেকে বিক্রি করা শুরু হয় এ সকল পণ্য। এমনকি তাদের দক্ষ করে তুলতে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছে দামুড়হুদা উপজেলা যুব উন্নয়ন অধিদফতর।

পণ্য তৈরিকারী নারী ও পুরুষরা জানান, এ সকল তৈরি পণ্য বাজারজাত করে বেশ লাভের মুখ দেখছেন তারা। বাংলাদেশ কুটির শিল্প কর্পোরেশনেও এ সকল পণ্যের নমুনা পাঠানো হয়েছে। জেলা শহর ছাড়াও বিভিন্ন স্থান থেকে অর্ডার পাওয়া শুরু হয়েছে তাদের। তবে লোকবল ও অর্থ স্বল্পতা থাকায় এ সকল পণ্য সরবরাহ করতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে। তাদের দাবী সহজ শর্তে সরকারিঋণ।

পাটাচোরা গ্রামের নাজমা খাতুন, দেওলী গ্রামের গৃহবধূ চম্পা খাতুন ও রুনা এবং কলেজ ছাত্রী পাপিয়া খাতুন বাড়ির উঠানে বসে রকমারি পণ্য তৈরি করতে করতে জানান, উপজেলা যুব উন্নয়ন অধিদফতরের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ নিয়ে পরিত্যক্ত কলা গাছের সুতা দিয়ে বিভিন্ন রকম পণ্য তৈরি করছেন তারা। এ পণ্যগুলো তৈরি করে অর্থ উপার্জন করায় তাদের পরিবারে আর্থিক সহযোগীতা আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হয়েছেন তারা।

কৃষি উদ্যোক্তা শাহিন আলী বলেন, কলা গাছের সুতা থেকে বেনুনি করে পাপোশ, টেবিলম্যাট, বাজারের ব্যাগ, ওয়ালম্যাট, ভ্যানিটিব্যাগ, শোপিস, ট্রে, পুরুষ-মহিলাদের অলংকারসহ বিভিন্ন পণ্য তৈরি করছেন। এছাড়া পরিত্যক্ত কলা গাছ থেকে সুতা এবং এর বর্জ্য থেকে ভার্মি ক¤েপাস্ট সার এবং জৈব সার তৈরি করে হচ্ছে। সরকারের সহায়তা দাবি করে তিনি বলেন, সহায়তা পেলে তার কর্মক্ষেত্রে আরও বেকার জনবল নিয়োগ করা সম্ভব হবে। ওই বেকার জনগোষ্ঠী আর্থিকভাবে স্বচ্ছল অর্জন করবে।

দামুড়হুদা উপজেলা যুব উন্নয়ন অধিদফতরের প্রশিক্ষক নাসরিন খাতুন জানান, গ্রামের অসহায় দরিদ্র নারী এবং ছাত্রীদের স্বাবলম্বী করে গড়ে তোলার জন্য এদেরকে প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষতা বাড়ানো হচ্ছে। প্রশিক্ষিত হয়ে এরা পরিত্যক্ত কলা গাছ থেকে তৈরি সুতা ব্যবহার করে অত্যন্ত সুন্দর করে নানা রকমের ব্যবহৃত পণ্য বানাচ্ছেন। এই পণ্যগুলো মান সম্মত করে প্রস্তুত করার জন্যই যুব উন্নয়ন এ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে।

দামুড়হুদা উপজেলা যুব উন্নয়ন কর্মকর্তা আব্দুল্লাহ আল-মামুন বলেন, যুব মহিলাদের দক্ষ জনশক্তিতে রূপান্তর করতে কাজ করে যাচ্ছে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর। সেই ফলশ্রুতিতেই এ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। দক্ষতা বাড়ানোর ক্ষেত্রে এ প্রশিক্ষণ অব্যাহত থাকবে।

দামুড়হুদা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. মনিরুজ্জামান বলেন, পাটাচোরা গ্রামের কৃষি উদ্যোক্তা শাহিন আলীকে সহায়তা করছে উপজেলা কৃষি বিভাগ। কারণ তিনি সফল হলে গ্রামীণ জনপদের আর্থ মানবতার উন্নয়ন সম্ভব হবে। কাজ করে অনেক বেকার নারীরা নিজে প্রতিষ্ঠিত হতে পারবেন। এ সকল পণ্য তৈরির প্রধান উপাদান কলা গাছ। তাই কলা চাষে এ এলাকার কৃষকদেরকে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। আর যারা ওই সকল পণ্য তৈরি করছেন, তাদেরকে উন্নত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও করা হচ্ছে। যাতে করে তারা আরো ভালোভাবে এ সকল পণ্য তৈরি করে অধিক মুনাফা অর্জন করতে পারে।

তিনি আরও বলেন, পরিত্যক্ত কলা গাছ থেকে সুতা তৈরি করছেন শাহিন। এই সুতা থেকে বিভিন্ন পণ্য তৈরি করছেন স্থানীয় নারীরা। ওই সকল নারীদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সেই পণ্য দেশের বাজারে বিক্রির পাশাপাশি ¯েপন, ফ্রান্স, কাতারসহ বিভিন্ন দেশে রফতানির চেষ্টা করা হচ্ছে। কুরিয়ারের মাধ্যমে এগুলো পাঠানো হচ্ছে। এসব দেশে পণ্যের চাহিদা দেখা দিলে আরও পাঠানো হবে। এক্ষেত্রে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতার বিশেষ প্রয়োজন।

One thought on “চুয়াডাঙ্গায় কলাগাছের সুতায় তৈরি পণ্য যাচ্ছে বিদেশে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *