তিন যুগের ইত্যাদি

Share Now..

তিন যুগে পা দিলো দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় একটি টিভি অনুষ্ঠান ‘ইত্যাদি’। একই সাথে ব্যক্তিগত উদ্যোগে কোনো অনুষ্ঠান এত দীর্ঘপথ সফলভাবে পাড়ি দিয়েছে সেটিও এদেশের এক অনন্য রেকর্ড। ‘ইত্যাদি’ কারিগর গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব হানিফ সংকেত ও তাঁর ইত্যাদি নিয়ে লিখেছেন তানভীর তারেক

হাসপাতালের বিছানায় এন্ড্রু কিশোরের কথালো!

ইত্যাদি, হানিফ সংকেত বা একজন এন্ড্রু কিশোর যেন একই সুতোয় গাঁথা। দেশের এই কণ্ঠসম্রাট যখন অসুস্থ ছিলেন পরিবারের মতো করেই খোঁজ রেখেছেন হানিফ সংকেত। সিঙ্গাপুরের হাসপাতালে দেখা করতে যখন যাই- দীর্ঘ আলাপ হয় বরেণ্য এই শিল্পীর সাথে। নানান প্রসঙ্গে আসে ইত্যাদির কথাটিও।

হানিফ সংকেত প্রসঙ্গে এন্ড্রু কিশোর বলেছিলেন, ‘তানভীর দেখো, একটি অনুষ্ঠানের যে আলাদা দায়বোধ থাকা প্রয়োজন তা ইত্যাদির আগে কেউ দেখায়নি। এই অনুষ্ঠানে যতবার আমি গেয়েছি। কিংবা যখন দীর্ঘ বিরতিতে গাইনি- ততবারই অনুষ্ঠানটির প্রতি দর্শকদের কি বিশাল আকুলতা লক্ষ করেছি। বলে বুঝানো সম্ভব না। তবে আমার এই প্রসঙ্গটা আনা ভিন্ন একটি কারনে। কারণ এসব ক্ষেত্রে যা হয়। একটি অনুষ্ঠান যখন উচ্চমাত্রায় জনপ্রিয় হয়ে যায়। তখন কিন্তু নানান ধরণের বাণিজ্য ভীড় করে। তারা বারবার নক করতে থাকে। এসব লোভণীয় অফার কিন্তু ফিরিয়ে দেয়াটা খুবই কঠিন। আমি যেভাবে এখন বলছি, বিষয়টি তার চেয়েও কঠিন। কিন্তু ইত্যাদি বিষয়টি দারুণভাবে হ্যান্ডল করেছে। এখানেই একটি ইত্যাদির সাফল্য। ইত্যাদি বাণিজ্যের কাছে বিক্রি হয়নি। নত স্বীকারও করেনি। হানিফ সংকেতের সাথে আমার নানান বিষয়ে অগণিত দিন কথা হয়েছে। মত-দ্বিমত হয়েছে। কিন্তু দিনশেষে বুঝেছি – ওর চিন্তাধারা, মেধা মননের অবস্থান অনেক উঁচু মানের।’ অনুষ্ঠান সম্পর্কে এ ধরণের কথা যখন এন্ড্রু কিশোর বলছিলেন তখন আনমনেই শিল্পী স্মৃতিতাড়িত হয়ে যেতে দেখেছি।

৩৬ বছরে পা

একটি শিশু ইত্যাদির সাথে জন্ম নিলে সে আজ ৩৬ বছরের পূর্ণ যুবক হয়েছে। তাই ইত্যাদির সাথে এই কয়েক জেনারেশনের ধারণ, এ এক বিষ্ময়কর অবস্থান এবং সাফল্য। যা একটি প্রতিবেদনে এর প্রকাশ সম্ভব না। সম্প্রতি আমার অস্ট্রেলিয়া সফরে সিডনীতে এক ভদ্রলোকের সাথে পরিচয় হয়। আরাফাত হোসেন তার নাম। পেশায় একজন ইঞ্জিনিয়ার। কিন্তু মনে প্রাণে তিনি একজন সাংস্কৃতিক কর্মী হিসেবেই পরিচয় দিতে ভালোবাসেন। ইত্যাদি বা হানিফ সংকেতের সাথে পরিচয় রয়েছে শুনে তিনি তার একটি অভিজ্ঞতার কথা শেয়ার করলেন। ইত্যাদি তার জীবনে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছে। দিনাজপুরের একটি গ্রামে তার জন্ম।

কথায় কথায় তিনি বললেন, ‘ছেলেবেলায় ইত্যাদির বিভিন্ন সামাজিক কাজের ভিডিও দেখে আমিও যে কোনোভাবে কারো উপকার করা যায় কি না, সেই পণ করেছিলাম। এলাকায় একটি গ্রুপ করে কোনো সহযোগিতা করা যায় কীনা। এরকম চেষ্টা করেছি। এটা করার মূল কারণ প্রথমে ছিল— অনুষ্ঠানে আমাকে ও আমার দলকে দেখানোর বাসনা। কিন্তু বিশ্বাস করুণ আমার পরিবার যা শেখায়নি, ইত্যাদি তা শেখাতে পেরেছে। আমি তখন আমার ৪ বন্ধুকে নিয়ে অসহায় বাচ্চাদের নানাভাবে হেল্প করতে লাগলাম। অবাক করার মতো বিষয় হলো এই পরোপকারের চর্চাটা করতে করতে আমার ভেতরে একসময় শুধু টিভিতে মুখ দেখানোর লোভটা কেটে গেল। কারণ আপনি যখন মন থেকে একটি ভাল কাজ করবেন, তখন তার জন্য বাড়তি প্রচারের লোভ করবেন না। আত্মার শান্তিই আপনার পুরস্কার মেনে নেবেন। আমার মনে হয় হানিফ সংকেত তার আত্মার শান্তির জন্যই এই অনুষ্ঠানটি করেন।’

কথাগুলো দার্শনিকের মতো শোনালো। কী ধ্রুব সত্য! এভাবে অগণিত প্রজন্মের কাছে অনুপ্রেরণার বাক্স যেন এই ইত্যাদি।

হানিফ সংকেত: সবচেয়ে কম সময় প্রচারে আসা মানুষ!

তার অবারিত সুযোগ। চাইলে যে কোনো কন্টেন্ট ক্রিয়েটরের মতো প্রতিদিনই বিভিন্ন বিষয় নিয়ে লাইভ করতে পারেন তিনি। কিন্তু এখানেও যেন এক বিষ্ময় ব্যক্তিত্বের পরিচয় তার। টিভি স্ক্রিনে বছরে ৮/৯ বার হাজির হন। কোনো বিশেষ অনুষ্ঠান ছাড়া যান না। গেলেও পরিমিত বক্তব্য বা বিষয় আশয় না বুঝে কথা বলেন না। যখন তাকে প্রশ্ন করি— এটা কেন করেন? অনেকেই তো আপনার কথাও শুনতে চায়! হানিফ সংকেত বলেছিলেন, ‘দেখুন, আমার কাজটাই আমার বর্হিঃপ্রকাশ। যে লেখেন তার লেখাটাই তার মোটিভেশন। যে গান করেন তার শ্রুতিমধুর গানই তার সমাজের জন্য আত্মনিয়োগ।’

এভাবেই এক নিবিষ্ট মানুষ তার একক প্রচেষ্টায় সমাজের শুদ্ধিকরণের কাজটি করে যাচ্ছেন। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে, এদেশের একাধিক টিভি চ্যানেল হানিফ সংকেতের এক্সক্লুসিভ ইন্টারভিউ নেবার জন্য প্রস্তাব দিয়েছেন। কিন্তু তিনি রাজি হননি। এমনকি এটিএন বাংলা হানিফ সংকেতের একটি এক ঘন্টার ইন্টারভিউ সেশনের জন্য ১ কোটি টাকা অফার করেছিলো এক সময়। তিনি ফিরিয়ে দিয়েছেন। বিশ্বের একাধিক চ্যানেল তাকে নিয়ে ডকুমেন্টারী প্রকাশ করেছে। নিজের কাজের প্রতি সত্ থেকে এভাবে আত্মনিয়োগে থাকা মানুষ এ পৃথিবীতে বিরল!

এবং মৌলভীবাজারের ইত্যাদি

হানিফ সংকেতের ইত্যাদি যখন যে জেলায় বা যে এলাকায় ধারণ করা হয়। তখন সেই এলাকায় যেন অলিখিত উত্সব শুরু হয়। টিভির একটি অনুষ্ঠান নিয়ে সারা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলকে তুলে ধরার এই অসাধারণ আইডিয়াটিও অন্য অনেক চ্যানেলের জন্য অনুকরণীয় হয়েছে। এবারের মৌলভীবাজারে অনুষ্ঠিত ইত্যাদির সেট বৈচিত্র সবকিছুই ছিল নান্দনিক। তবে বিশেষ করে বলতে হয়— টিভি বা স্যাটেলাইট তারকারা যে নিজের কাজের বাইরের নানান উদ্ভট বা ব্যক্তিজীবনে বিতর্কিত কাজ নিয়ে আলোচনায় থাকেন এবং গণমাধ্যম যে সেই সব মেধাহীন তারকাদের দিকেই ছোটে— এ নিয়ে স্যাটায়ার ছিল দারুণ।

শোক স্টুডিও— সেগমেন্টে গানের নানান ফিউশন করে যে সংস্কৃতির বারোটা বাজছে তা দেশের কোনো গণমাধ্যমই বলার সাহস পেলোনা। ইত্যাদি’কে বলতে হলো।

তারকা সাপ্লাইয়ের ক্ষেত্রে টক শো তারকাদের ডিমান্ড বেশি— এই সেগমেন্ট তো এখনকার বাস্তবতার অংশ। এ ধরণের নানান অসঙ্গতির কথা যখন উঠে আসে শুধু ইত্যাদি’তেই তখন দেশের গণমাধ্যমের সমালোচকদেরও এক ধরনের লজ্জা দেয়া হয়। কারণ সমাজের দর্পন হিসেবে শুধু ইত্যাদিতে সমসাময়িক ও প্রাসঙ্গিক এসব আলাদা উঠে আসে।

লেখাটি শুরু করেছিলাম এন্ড্রুদাকে নিয়ে। এন্ড্রু কিশোর আজ নেই। এমন অনেক বরেণ্যকে হারিয়েছি আমরা। যারা ইত্যাদির এই ৩ যুগে এসেছেন। কিন্তু পুরো বাংলাদেশের সংস্কৃতির যে দারুণ একটি রূপ হানিফ সংকেত তার ইত্যাদির মাধ্যমে ধারণ করে রাখলেন। আমাদের বাংলাদেশের কৃষ্টি কালচার নিয়ে যে কোনো গবেষনায় ‘ইত্যাদি’ তাই হয়ে উঠেছে অমূল্য এক প্রামান্য দলিল।

তিন যুগের ইত্যাদি ও হানিফ সংকেতকে অভিনন্দন। শুভকামনা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *