‘দুই পাকিস্তানি সৈন্যকে হত্যা করে ক্যাপ-অস্ত্র নিয়ে আসি’
‘জামালপুর জেলার বকশীগঞ্জ উপজেলার সীমান্তসংলগ্ন কামালপুর বিওপিতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রতিরক্ষা ঘাঁটিতে সরাসরি আক্রমণ করা হবে। এজন্য ঘাঁটির চারপাশ মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল ১৯৭১ সালের ২৮ জুলাই ছদ্মবেশে দিনের বেলায় রেকি করল।’
‘রাতের বাস্তব অবস্থাও দেখা প্রয়োজন। সীমান্তের ওপারের মুক্তিবাহিনীর শিবির থেকে বেরিয়ে পড়লেন কয়েক জন মুক্তিযোদ্ধা। ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দীন মমতাজ (বীর উত্তম), লেফটেন্যান্ট মো. আবদুল মান্নান, সুবেদার আবদুল হাই (বীর প্রতীক), সুবেদার হাশেম ও নায়েক সফি। তাদের দলনেতা সালাহউদ্দীন মমতাজ। সাড়াশব্দহীন অন্ধকার রাত। রাতের অন্ধকারে তারা ঘাঁটির আশপাশ পর্যবেক্ষণ করছেন। অন্ধকারে ভুল করে তারা চলে গেলেন পাকিস্তানি এক অবজারভেশন পোস্টের একদম কাছে।
সেখানে ছিল দুই পাকিস্তানি সেনা। দুজনের একজন হল্ট বলে চিৎকার করে উঠল। ঐ পাকিস্তানি সেনাকে কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই জাপটে ধরে মাটিতে ফেলে দিলেন সালাহউদ্দিন মমতাজ। আবদুল মান্নান তখন সিদ্ধান্ত নিলেন, গুলি করলে সালাহউদ্দিন মমতাজও মারা যেতে পারেন। তাই বন্দুকের নল ঠেকালেন ঐ পাকিস্তানি সৈন্যের পাঁজরে। বুঝতে পেরে ঐ সৈন্য মমতাজকে ছেড়ে ছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে তিনি গুলি করলেন ঐ সৈনিককে। ঘটনার আকস্মিকতায় অপর পাকিস্তানি সেনা হতভম্ব। প্রতিরোধের সুযোগ না দিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা তাকেও হত্যা করলেন। এরপর তারা দুই পাকিস্তানি সেনার মাথার ক্যাপ ও অস্ত্র নিয়ে ফিরে এলেন নিজেদের শিবিরে।’
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে নিজেদের অপারেশনের কথা বলতে গিয়ে ইত্তেফাকের কাছে এভাবেই বলছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা লে. কর্নেল (অব.) আবদুল মান্নান বীর বিক্রম। ১৯৬৮ সালেই তিনি লেফটেন্যান্ট পদে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। ১৯৭১ সালে তিনি জয়দেবপুর ক্যান্টনমেন্টে কর্মরত ছিলেন। ১ মার্চ তাকে সেগুনবাগিচায় (বর্তমান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পুরাতন ভবন) অস্থায়ী অপারেশন রুমে পাঠানো হলো।
‘যুদ্ধের প্রস্ত্ততি হিসেবে ওরা আগে থেকেই এখানে অস্থায়ী হাসপাতাল তৈরি করেছিল ওদের সেনাদের চিকিত্সার জন্য। এখানে ১৭ দিন ডিউটি করার পর বুঝতে বাকি রইল না যে, ওরা কী করতে চায়। আমি ফিরে যেতে চাইলাম। অনুমতিও পেয়ে গেলাম। ফেরার দিন টঙ্গীতে অবরোধের মধ্যে পড়লাম। বাঙালি অফিসার হিসেবে আমাকে ছেড়ে দেওয়া হলো। গভীর রাতে পৌঁছলাম জয়দেবপুরে। পরদিন নিজের ইচ্ছায় পোস্টিং চাইলাম ময়মনসিংহ। কারণ সেখানে দায়িত্বে ছিলেন মেজর জেনারেল নুরুল ইসলাম সিকদার। মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়ার উদ্দেশ্যেই আমি বাঙালি অফিসারের অধীনে পোস্টিং নিয়েছিলাম।’
এই বীর মুক্তিযোদ্ধা বলছিলেন, ‘১৮ মার্চ আমি সন্ধ্যার ট্রেনে ময়মনসিংহ গেলাম। গভীর রাতে সেখানে পৌঁছে দেখি জেনারেল নুরুল ইসলাম আমাকে রিসিভ করার জন্য অপেক্ষা করছেন। সঙ্গে তিনি কাউকে আনেননি। আমি তো বিস্মিত। আমার মতো একজন জুনিয়র অফিসারকে রিসিভ করার জন্য তিনি কেন এসেছেন? সবকিছু শেষ করে তার সঙ্গে গাড়িতে উঠে পড়লাম। সেখানেই মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আমাদের প্রথম পরিকল্পনা হলো। ২৫ মার্চের অপারেশনের রাতে আমরা ব্যারাকেই অবস্থান করছিলাম। ২৬ মার্চ সিদ্ধান্ত নিলাম এখনই কিছু করতে হবে। সেখানেই আমরা লোকজনকে একত্রিত করে প্রথমে ছয় জন বিএসএফ সদস্যকে বন্দি করি। ঐখানে ক্যান্টেন কমোর আব্বাসের সঙ্গে আমাদের ব্যাপক গোলাগুলি হয়। সেখানে টিকতে না পেরে আমরা ব্রহ্মপুত্র পাড়ি দিয়ে উত্তরের দিকে চলে গেলাম। সেখানে গ্রামের লোকজন আমাদের রান্না করে খাইয়েছেন। এক পর্যায়ে সিলেট সীমান্ত দিয়ে ভারতে গেলাম। সেখানে দেখা হলো, জেনারেল সফিউল্লাহ, জেনারেল আজিজ, জেনারেল মঈনসহ অনেকের সঙ্গেই। আমাদের সঙ্গে তো জেনারেল নুরুল ইসলাম ছিলেন। দুই তিন দিন সেখানে থাকার পর কুমিল্লার দিকে আমাকে পাঠানো হয়।’