ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে যেভাবে উদ্ধার করা হলো দুই বোনকে

Share Now..


তুরস্ক ও সিরিয়ায় ভূমিকম্পে মৃতের সংখ্যা ৩৪ হাজার ছাড়িয়েছে। এর মধ্যে তুরস্কের ২৯ হাজার ৬০৫ এবং সিরিয়ায় মৃতের সংখ্যা ৪ হাজার ৫৭৪ জন। তুরস্কে ধ্বংসস্তূপ থেকে যাদের জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে তাদের মধ্যে ছিলেন মার্ভ ও ইরেম নামের দুই বোন। খবর বিবিসি। ধ্বংসস্তূপের নিচে কান পেতে আছেন উদ্ধারকর্মীরা। যদি কোনো জীবিত মানুষের গোঙানির শব্দ পাওয়া যায়, সেই আশায়। কারণ, উদ্ধারকারী দলটি জানতে পেরেছে, এ ধ্বংসস্তূপের নিচে মারভি ও ইরেম নামে দুই বোন আটকা পড়ে আছেন। তারা এখনো জীবিত—জানিয়েছে এই ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে জীবিত উদ্ধার হওয়া অন্যরা।

মার্ভ! ইরেম! মার্ভ! ইরেম! উদ্ধারকর্মী মুস্তাফা ওজতুর্ক চিৎকার করেই যাচ্ছেন। আমাদের চারপাশের সবাইকে বলা হলে নিশ্চুপ থাকতে। উদ্ধারকর্মীদের এই দলটি দুই বোনকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। খুবই সংবেদনশীল কিছু যন্ত্র দিয়ে উদ্ধারকর্মীরা শোনার চেষ্টা করছে কোন সাড়া পাওয়া যায় কি না। কোন একটা কিছুর আশায় সবাই যেন স্থির হয়ে আছে।

তারপরই যেন একটা কিছু ঘটলো। “ইরেম, প্রিয় ইরেম, আমি তোমার খুব কাছে, তুমি আমাকে শুনতে পাচ্ছো?, চিৎকার করে জানতে চাইলেন মুস্তাফা। আমরা যারা দেখছিলাম, তারা কিছু শুনতে পেলাম না। কিন্তু মনে হচ্ছে, ইরেম এখন সাড়া দিচ্ছে। মেয়েটির এক দল বন্ধু আমাদের সঙ্গে চুপচাপ বসে আছে।

তুমি খুবই দারুণ! এখন দয়া করে শান্ত থাকো, আমার কথার জবাব দাও। আচ্ছা, ও তাহলে মার্ভ। প্রিয় মার্ভ, আমার প্রশ্নের উত্তর দাও”, বলছিলেন মুস্তাফা।

দক্ষিণ তুরস্কের আনতাকিয়ার একটি পাঁচতলা অ্যাপার্টমেন্ট ব্লকের ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে আছে ২৪ বছর বয়সী মার্ভ এবং তার বোন ১৯ বছরের ইরেম। ভূমিকম্পে এই ভবনটি মাটিতে মিশে গেছে। দুদিন পেরিয়ে গেছে, কিন্তু ওদের জন্য এটি যেন কয়েক সপ্তাহ।

“আজকে বুধবার। না! তোমরা ১৪ দিন ধরে আটকে নেই। আমাদের আর পাঁচ মিনিট সময় দাও। তোমাদের বের করে আনবো।”

মুস্তাফা জানেন, এদের উদ্ধারে আরও কয়েক ঘণ্টা সময় লাগবে। কিন্তু আমাদের বললেন, “ওরা যদি আশা হারিয়ে ফেলে ওরা বাঁচবে না।”
মার্ভ এবং ইরেম এক সঙ্গে কৌতুক আর হাসাহাসি শুরু করলো। মুস্তাফার মুখে যেন আমি বিরাট হাসি দেখলাম: “যদি ভেতরে ওরা জায়গা পেত, ওরা হয়তো নাচানাচি করতো,” বলছিলেন তিনি।

উদ্ধারকর্মীদের হিসেব অনুযায়ী, দুই বোনের কাছে পৌঁছাতে আরও দুই মিটার খুঁড়তে হবে। কিন্তু উদ্ধারকর্মী দলের অধিনায়ক হাসান বিনায় বললেন, কংক্রিটের মধ্যে সুড়ঙ্গ খোঁড়া খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। একটা ভুল পদক্ষেপে বিরাট বিপর্যয় ঘটে যেতে পারে।

যখন তারা খোঁড়া শুরু করলো, তখন একটা পুরো কংক্রিট তুলে ধরে রাখার জন্য বুলডোজার আনা হলো।

“মেয়েরা, আমরা শীঘ্রই তোমাদের কম্বল দেব”, মুস্তাফা তাদের জানালেন।

“না না, আমাদের নিয়ে চিন্তা করো না। আমরা ক্লান্তও নই, আমাদের শীতও লাগছে না।”

মুস্তাফা বললেন, মার্ভ চিন্তা করছে উদ্ধারকর্মীদের অবস্থা নিয়ে। স্থানীয় সময় এখন রাত সাড়ে আটটা। বেশ ঠাণ্ডা। এই এলাকায় স্মরণকালের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ শীত পড়েছে। উদ্ধার কর্মীরা আবার ধ্বংসস্তূপের ভেতর তাদের খালি হাত দিয়ে বেশ দ্রুত খনন শুরু করলো।

কয়েক ঘণ্টা পর আমরা অনুভব করলাম, আমাদের পায়ের নিচের মাটি কাঁপছে। বেশ শক্তিশালী আফটারশক। এখন উদ্ধার অভিযান বন্ধ রাখতে হবে। এখান থেকে আমাদের সরে যেতে হবে। এখানে এটা একটা নির্মম বাস্তবতা। আমাদের উদ্ধারকারী দলের নিরাপত্তা আমাদের প্রথম অগ্রাধিকার”, বলছিলেন হাসান।

তিরিশ মিনিট পর মুস্তাফা এবং আরও তিনজন উদ্ধারকর্মী আবার খনন কাজে ফিরে গেলেন।

“ভয় পেয়ো না। বিশ্বাস করো, আমরা তোমাদের ফেলে চলে যাবো না। আমি তোমাদের বের করে আনবো। এরপর তোমরা দুজন আমাদের লাঞ্চ খাওয়াতে নিয়ে যাবে”, চিৎকার করে বলছিলেন মুস্তাফা। মেয়ে দুটি ভেবেছিল, তাদের ফেলে সবই চলে গেছে, তাদের বুঝি ওখানেই মরতে হবে।

এখন মধ্যরাত, আবার খনন কাজ শুরু হয়েছে। উদ্ধারকারী দল কয়েক রাত ধরে ঘুমায় না। আমরা ধসে পড়া ভবনের কাছে একটা অগ্নিকুন্ডলি ঘিরে জড়ো হয়েছি। একটু পর পর হাঁক শোনা যাচ্ছে: “সেসিজলিক।” এর মানে হচ্ছে “চুপ।” আলো নিভে গেল, চারিদিকে অন্ধকার। কংক্রিটের মধ্যে ওরা একটা ছোট্ট ছিদ্র করেছে, মেয়ে দুটি মুস্তাফার টর্চের আলো দেখতে পারছে কি না, সেটা জানার জন্য।

“মার্ভ! ইরেম! তোমরা কি আলো দেখতে পাচ্ছো? পাচ্ছো? বেশ ভালো। আমি এখন একটা ছোট্ট ক্যামেরা পাঠাচ্ছি। যখন তোমরা এটা দেখতে পাবে, আমাকে জানাবে। এরপর আমি তোমাদের জানাবো কী করতে হবে।”

সবার জন্য এটি এক আনন্দের মূহুর্ত। নাইট ভিশন ক্যামেরাটি একটা ছোট্ট পর্দার সঙ্গে যুক্ত। হাসান ওর দলের সঙ্গে যোগ দিল দুই বোনের ছবি দেখার জন্য। তারা এখন ইরেম এবং মার্ভ, দুজনকেই দেখতে পাচ্ছে।

“তোমরা কী সুন্দর। বেশি নড়াচড়া করো না। ইরেম ক্যামেরাটা একটু ওপরে তোল, যাতে আমরা মার্ভকে আরেকটু ভালোভাবে দেখতে পারি।” পর্দায় দেখলাম, ইরেম হাসছে। সৌভাগ্যবশত কংক্রিটের যে জায়গায় তারা আটকে পড়েছে, সেখানে তাদের দুজনের জন্য যথেষ্ট জায়গা আছে। সবার মুখে এখন স্বস্তির ছায়া। মেয়ে দুটি ভালোই আছে। যদি ফুটোটা আরেকটু বড় করা যায়, ইরেম সেদিক দিয়ে বেরিয়ে আসতে পারবে।

কিন্তু এরপরই উদ্ধারর্মীদের মধ্যে উদ্বেগ দেখা গেল। মার্ভ জানালো, তার হঠাৎ ঠাণ্ডা লাগতে শুরু করেছে। তার পায়ের ওপর ভারী কিছু পড়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *