পদ্মা সেতু চালু হলে ঘুরে দাঁড়াবে যশোরের দুই বন্দর

Share Now..

এস আর নিরব যশোরঃ
আর মাত্র ৫ দিন পর উদ্বোধন হতে যাচ্ছে পদ্মা সেতু। এর পরদিন থেকে খুলে দেয়া হবে যানবাহন চলাচলের জন্য। এই সেতুকে ঘিরে দক্ষিণ-পশ্চিমের ২১ জেলার অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের তরান্বিত হবে। যার ভাগিদার হবে যশোর জেলাও। যশোর জেলাটিতে দুটি বন্দর রয়েছে। একটি হলো দেশের সর্ববৃহৎ স্থলবন্দর বেনাপোল ও নওয়াপাড়া নৌ-বন্দর। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পদ্মা সেতুকে ঘিরে ঘুরে দাঁড়াবে এই দুটি বন্দর। বাড়বে বাণিজ্যিক কার্যক্রম। তবে পূর্ণ বাণিজ্যিক সুবিধা পেতে বন্দর দুটিকে তার সক্ষমতা বাড়াতে হবে অভিমত ব্যবসায়ীদের।

বেনাপোল কাস্টম সূত্রে জানা গেছে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে পণ্য আমদানি করা হয়েছে ২০ লাখ ১১ হাজার ৬ মেট্রিক টন পণ্য, ২০১৯-২০ অর্থবছরে পণ্য আমদানি করা হয়েছিল ২০ লাখ ৩৮ হাজার ৬৪ মেট্রিক টন, ২০২০-২১ অর্থবছরে আমদানি হয়েছে ২৭ লাখ ৭৭ হাজার ৬০৬ মেট্রিক টন। আমদানি ও রফতানি থেকে বন্দর ও কাস্টমস রাজস্ব আদায় করে কমপক্ষে ৮ হাজার কোটি টাকা। পদ্মা সেতু চালুর পর আরও গতি বাড়বে বেনাপোল বন্দরে।

পদ্মা সেতু চালুর পর নওয়াপাড়া বন্দর দিয়ে বাণিজ্য সুবিধা দ্বিগুণ হবে। এই সেতুকে ঘিরে যশোর ও মোংলায় শিল্প প্রতিষ্ঠান হবে। তখন মোংলা সুমদ্র বন্দর দিয়ে আমদানি বাড়বে। আর মোংলায় জাহাজ বাড়লে নওয়াপাড়া নৌবন্দর ব্যবহার বাড়বে- নওয়াপাড়া নৌ-বন্দরের উপ-পরিচালক মাসুদ পারভেজ

বেনাপোল কাস্টমস কমিশনার মো. আজিজুর রহমান বলেন, পদ্মা সেতু চালুর পর যাতায়াত সহজ হবে। কম সময়ের মধ্যে আমদানিকৃত পণ্য ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় পৌঁছাবে। একারণে বেনাপোল দিয়ে আমদানি রফতানিতে আরও গতি বাড়বে। তবে বন্দরের সক্ষমতা না বাড়লে সেই সুফল মিলবে না। ব্যবসায়ীরা যদি তাদের আমদানি করা পণ্য এনে বন্দরে না রাখতে পারেন তা হলে তো লাভ হবে না।

বেনাপোল আমদানি-রফতানি সমিতির সিনিয়র সহ-সভাপতি আমিনুল হক জানান, বেনাপাল বন্দর দিয়ে বছরে লাখ মেট্রিক টন পণ্য আমদানি হয়ে থাকে। কিন্তু বন্দরে রাখার সক্ষমতা রয়েছে ৪৭ হাজার মেট্রিক টনের। যেকারণে ব্যবসায়ীরা চাহিদা অনুযায়ী পণ্য আনতে পারছে না। বন্দরের পরিধি বাড়লে পদ্মা সেতুর কারণে বাণিজ্য বাড়বে।

বেনাপোল সিএন্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সহসভাপতি মহসিন মিলন বলেন, পদ্মা সেতুর কারণে পণ্যবাহী গাড়ি চলাচল সহজ হবে। এতে আমদানিকারকরা আগ্রহী হবেন। আশা করছি বেনাপোল বন্দর দিয়ে বাণিজ্য কার্যক্রম আরও গতিশীল হবে।

ভারত-বাংলাদেশ ল্যান্ডপোর্ট ইমপোর্ট এক্সপোর্ট কমিটির পরিচালক মতিয়ার রহমান জানান, ব্যবসায়ীরা যেখানে সুবিধা পাবেন সে পথে আমদানি, রফতানি বাণিজ্যে আগ্রহী হবেন এটাই স্বাভাবিক। পদ্মা সেতুর কারণে সড়ক পথে কম সময় লাগবে ঢাকায় যেতে। এতে সবাই আগ্রহ দেখাবে। বেনাপোল বন্দর দিয়ে রাজস্ব আয় বাড়াতে হলে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে কাস্টমস ও বন্দরে বৈধ সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। তাহলে ব্যবসায়ীরা এ পথে আবার ফিরবেন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে,বেনাপোল বন্দরের উপ-পরিচালক (ট্রাফিক) মামুন কবীর জানান, পদ্মা সেতুর কারণে বন্দর দিয়ে বাণিজ্য গতিশীলতা বৃদ্ধি পাবে। ইতিমধ্যে বন্দরে ৩৬৫টি সিসি ক্যামেরা স্থাপনের কাজ শেষ হয়েছে। বন্দরের অবকাঠামো উন্নয়নে প্রায় ৪শ কোটি টাকার উন্নয়ন কাজ চলমান। প্রয়োজনে আর একশ একর জমি অধিগ্রহণ করা হবে। এসব উন্নয়ন কাজ সমাপ্ত হলে এ বন্দরে বাণিজ্যে আরো গতি বাড়বে।

বেনাপোলের মতো নওয়াপাড়া নৌ-বন্দরেও পদ্মা সেতুর সুফল মিলবে বলে বলছেন বন্দর কর্তৃপক্ষ ও ব্যবসায়ীরা। নওয়াপাড়া নৌ-বন্দরের উপ-পরিচালক মাসুদ পারভেজ বলেন, ৪৪ কোটি টাকা ব্যয়ে বন্দরের ৩৭ কিলোমিটারে ৩০ লাখ ঘনমিটার ড্রেজিংয়ের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। আরও কাজ করা হচ্ছে। কেননা পদ্মা সেতু চালুর পর এই বন্দর দিয়ে বাণিজ্য সুবিধা দ্বিগুণ হবে। এই সেতুকে ঘিরে যশোর ও মোংলায় শিল্প প্রতিষ্ঠান হবে। তখন মোংলা সুমদ্র বন্দর দিয়ে আমদানি বাড়বে। আর মোংলায় জাহাজ বাড়লে নওয়াপাড়া নৌবন্দর ব্যবহার বাড়বে। এই অঞ্চলের ব্যবসায়ীরা ছোট বা বড় কার্গো জাহাজে করে পণ্য আনবে।

বন্দরটিতে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে এক হাজার ৪৬৮টি জাহাজে আমদানি পণ্য এসেছিল ৭ লাখ ৮৪ হাজার মেট্রিক টন, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দুই হাজার ৫টি জাহাজে পণ্য এসেছে ১০ লাখ ৩৩ হাজার ৭শ মেট্রিক টন। ২০১৯-২০ অর্থবছরে দুই হাজার ৩শ জাহাজে ১১ লাখ ৫০ হাজার ৩শ মেট্রিক টন পণ্য এসেছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে পণ্য এসেছে ১৫ লাখ মেট্রিক টন। এই বন্দর দিয়ে মূলত সার, সিমেন্ট, কয়লা, গমসহ বিভিন্ন পণ্য এসে থাকে। পদ্মা সেতুর কারণে যোগাযোগ ব্যবস্থায় বিপ্লব ঘটলে এ বন্দর ব্যবহার বেড়ে যাবে। কারণ এখান থেকে খালাসকৃত পণ্য কম সময়েই ট্রাকে তুলে ঢাকায় পাঠানো সম্ভব হবে।

জানা গেছে, ২০০৪ সালের এপ্রিলে ঘোষণা দেওয়া হয় যশোরের অভয়নগর উপজেলার নওয়াপাড়ায় নদীবন্দর স্থাপনের। ২০০৭ সালের মে মাসে শুরু হয় এর কার্যক্রম। ভৈরব নদের চেঙ্গুটিয়া থেকে ভাটপাড়া ফেরিঘাট পর্যন্ত প্রায় সাড়ে বারো কিলোমিটার দীর্ঘ সীমানা নির্ধারণ করা হয় নদী বন্দরটির। স্থাপন করা হয় ছয়টি পন্টুন। আয় হতে থাকে রাজস্ব। সময়ের সাথে বেড়েছে রাজস্ব আয়। কিন্তু এতটুকুও বাড়েনি নদীবন্দরের উন্নয়ন কাজ।
ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করেন, প্রয়োজনীয় স্থাপনা নির্মাণ, ওয়ার হাউজের সুবিধাদি বৃদ্ধি, নদী ভাঙ্গনরোধে কী-ওয়াল নির্মাণ, মালামাল ওঠানামার জন্য আরসিসি সিঁড়ি নির্মাণ এবং মালবাহী ট্রাকের জন্য পার্কিং ইয়ার্ড নির্মাণ করেনি বন্দর কর্র্তৃপক্ষ। বন্দরটি আধুনিকায়নের ক্ষেত্রেও নেওয়া হচ্ছে না কোনো প্রকল্প। সরকার এ বন্দর থেকে প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা রাজস্ব আদায় করলেও তারা সকল প্রকার সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন বলে অভিযোগ করেন।

নওয়াপাড়া সার ও খাদ্যশস্য ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক শাহ জালাল হোসেন বলেন, ভৈরব নদকে ঘিরে নওয়াপাড়ার ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটেছে। আমরা ঠিকমতো ট্যাক্স দিচ্ছি। কিন্তু নদী বন্দরের কোনো উন্নয়ন হচ্ছে না। এখানে ছোট জাহাজ আসলেও ঘাটে ভিড়তে পারে না। এজন্য আমরা গাইডল নির্মাণের দাবি করেছিলাম। কিন্তু তা করা হয়নি। পদ্মা সেতুর কারণে বন্দরটিতে বাণিজ্য সুবিধা বৃদ্ধি পাবে। তখন অবকাঠামোর সুবিধা না বাড়লে সেই বাণিজ্য সুবিধা মিলবে না।

এ বিষয়ে যশোর চেম্বার অব কমার্সের সাবেক পরিচালক হুমায়ুন কবীর কবু বলেন, পদ্মা সেতুকে ঘিরে অর্থনৈতিক ব্যাপক উন্নয়ন হবে। সড়ক পথে পণ্যবাহী ট্রাক পৌঁছাতে কম সময় লাগবে। এতে বেনাপোল ও নওয়াপাড়া নৌ-বন্দরে বাণিজ্য সুবিধা বেশি পাওয়া যাবে। একই সাথে আমি দাবি জানাচ্ছি পদ্মা সেতুর সাথে যশোর রেলপথ নির্মাণ ও গ্যাস লাইন স্থাপন করতে হবে। তখন জেলার অর্থনীতি পূর্ণতা পাবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *