পাকিস্থানে পাচার হওয়া ৩৫ বছর পর দেশে ফিরলেন সাজেদা

Share Now..

জেলা প্রতিনিধি, ঝিনাইদহ॥
১৯৮৫ সালের দিকে জাহেদা খাতুনকে বিয়ে দেওয়া হয় পাবনা ঈশ্বরদীতে। বিয়ের কয়েকবছর পর তাকে নেশা জাতীয় ওষুধ খায়িয়ে বিক্রি করে দেয় তার শ্বশুর বাড়ীর লোকজন । কিন্তু জাহেদার পরিবারকে বলা হয় তিনি বাড়ীর উদ্দেশ্যে চলে গেছেন। অনেক খোজাখুজির পর তাকে না পেয়ে পরিবার ভেবেছিল তিনি মারা গেছেন। কিন্তু মায়ের মন সবসময় চেয়েছে মেয়ে একদিন ফিরে আসবে। দির্ঘ অপেক্ষার পর সেই জাহেদা প্রায় ৩৫ বছর পর ফিরে এসেছে পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশে। জাহেদা খাতুনের বর্তমান বয়স প্রায় ৫৫ বছর। বাড়ী ঝিনাইদহের ভুটিয়ারগাতী গ্রামে। মৃত জব্বার আলী শেখের বড় মেয়ে তিনি।

গত ২৮শে আগষ্ট রাতে তিনি বাংলাদেশে বিমান যোগে পাকিস্থান থেকে দেমে আসেন। পরেরদিন ২৯শে আগষ্ট বিকালে তিনি ঝিনাইদহের নিজ বাড়িতে ফেরেনে। জাহেদা মাত্র ৩ মাসের ভিসায় পরিবারের কাছে ফিরেছে। সময় শেষ হলেই তাকে পাকিস্তানে ফিরতে হবে।

জাহেদার পরিবারের লোকজন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ৪০ বছর আগে জাহেদার বিয়ে হয় পাবনা জেলার ঈশ্বরদীর রহিমের সাথে। পরিবার জানতো না তার ঘরে সতিন আছে। শ্বশুর শাশুড়ি ও ননদ ষড়যন্ত্র করে জাহেদাকে নেশা জাতীয় কিছু খাইয়ে অজ্ঞান করে বিক্রি করে দেয়। পরে তার যখন জ্ঞান ফিরে তিনি দেখেন সম্পূর্ণ ভিন্ন এক জায়গা। পরবর্তীতে তিনি বুঝতে পারলেন এটা বাংলাদেশ নয়। এ হচ্ছে পাকিস্থানের করাচি। সেখানেই তাকে বিক্রি করা হয়। তাও আবার দুই বার।

একপর্যায়ে এক আলেম তাকে পেয়ে কিনে মুক্ত করে দেন। তখন বাংলাদেশে ফিরে আসার কোন ব্যবস্থা করতে না পেরে তিনি জাহেদাকে এক পাকিস্তানি যুবক গুল্লা খানের সাথে বিয়ে করিয়ে দিলেন। জাহেদার জীবনে একটু স্বস্থি ফিরে আসে। সেখানে তার এক মেয়ে ইয়াসমিন (২২) রয়েছে। কিন্তু অন্তরে তার নিজ দেশ, মা, বাবা, ভাই বোনের প্রতিচ্ছবি ভাসছিল।

এরপর পাকিস্থানে ডধষরঁষষধয গধৎড়ড়ভ (এফবি এ্যাকাউন্ট) নামের এক ছেলের সাথে তার পরিচয় হয়। তিনি ২০১৮ সাল থেকে ফেসবুকে নিয়মিত পোষ্ট দিতে থাকেন। সেই পোষ্ট চোখে পড়ে নেত্রকোনা জেলার ছেলে মনজুর আহমেদের। এরপর তাদের যোগাযোগ হতে হতে পরিবারের সাথে কথা হয় জাহেদার। জাহেদা বাড়ী ফিরতে চান। কিন্তু টাকা ও পাসপোর্টের অভাবে তিনি ফিরতে পারেন না। পরে ডধষরঁষষধয গধৎড়ড়ভ ই সব ব্যবস্থা করে তাকে দেশে পাঠান।

মোঃ মুনজুর আহম্মদ ঢাকা পোস্টকে জানান, তিনি ইসলামি বিশ^বিদ্যালয়ে ইসলামি বিভাগে পড়াশোনা করেন। তার বাসা নেত্রকোন জেলায়। তিনি ২০১৮ সালের নভেম্বর মাসে ফেসবুকে একটি পোস্ট দেখতে পান। সেখানে উর্দু থেকে বাংলায় অনুবাদ করে প্রচার করার সহযোগীতা চেয়ে আবেদন করা হয়। এরপর তিনি দেখতে পান ঝিনাইদহ জেলায় জাহেদা খাতুন পাকিস্থান থেকে দেশে আসার জন্য খুবই কান্না কাটি করছে। উর্দুতে লেখার পর তিনি ঝিনাইদহের বিভিন্ন জায়গাই তার পরিবারের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেন। কিন্তু প্রথমে ব্যার্থ হলেও কিছুদিন পর পরিবারের সাথে যোগাযোগ করতে সক্ষম হন। কিন্তু জাহেদার পরিবারের পক্ষ থেকে দেশে ফিরিয়ে আনবে এমন সামর্থ ছিলো না। এরপর তারা আবারও আমার সাথে যোগাযোগ করে সব বিষয় খুলে বলে। তখন পাকিস্থানের ওলিউল্লাহ মারুফের সাথে কথা বললে, সে পাকিস্থান থেকে তাদের বন্ধুদের সহযোগীতায় জাহেদার পাসফোট ও ভিসার ব্যবস্থা করেন। এরপর জাহেদা দেশে ফিরেছেন। তার দেশে ফিরে আসার পেছনে অনেকে সহযোগীতা করেছেন।
জাহেদার মা রজিয়া বেগম ঢাকা পোস্টকে জানান, সন্তানের জন্য যে মায়ের কত পোড়া, তা একমাত্র আল্লাহই জানেন। তিনি সবসময় আল্লাহর নিকট দোয়া করতেন তার মেয়ে যেন তার কাছে ফিরে আসে। আল্লাহ তার ডাক শুনেছেন বলেই তার মেয়ে তার কাছে ফিরে এসেছেন।

জাহেদর ভাই রবিউল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে জানান, তার বোন জাহেদা যখন নিখজ হয় তখন তিনি ২য় শ্রেণীতে পড়তেন। বোনের বিবাহ হয় পাবনায়। দির্ঘদিন স্বামীর বাড়ি থেকে বোন ফিরে না আসায় তাদের পরিবার থেকে পাবনা যায় জাহেদার খোঁজে। কিন্তু সেখান থেকে জানিয়ে দেয় তার বোন অনেক দিন হলো বাপের বাড়ি ঝিনাইদহ যাবে বলে রওনা দিয়েছেন। কিন্তু বোন বাড়িতে ফিরে না আসায় অনেক খোঁজাখুঁজির পর তাকে না পেয়ে হাল ছেড়ে দিয়। এরপর দির্ঘ ৩০ বছর পর নেটে ছেড়ে দিয়ে মনজুর নামে এক ছেলে দেখে সে আমাদেরকে খোঁজ করে। তারপর সবকিছু জানার পর তাদের সহযোগীতায় আমাদের বোন বাড়িতে ফিরে আসেন।

জাহেদা খাতুন ঢাকা পোস্টকে জানান, পাবনা শ^শুর বাড়ির লোকজন তাকে পাকিস্থানে বিক্রি করে দেয়। পরে সেখানে এক আলেমের সাথে তার পরিচয় হয়। এরপর ওই আলেম তাকে পাকিস্থানি গুল্লা খানের সাথে বিবাহ দেয়। সেখানে তার একটা মেয়েও হয়। কিন্তু দেশে আসার কোন উপায় তার জানা ছিলো না। এরপর ডধষরঁষষধয গধৎড়ড়ভ এর সাথে আবারো যোগযোগ করি সে আমাকে ফেসবুকের মাধ্যমে বাংলাদেশের নেত্রকোনা জেলার মনজুর আহমেদের সাথে যোগাযোগ করে আমার পরিবারের সাথে যোগাযোগ করে। এরপর তিনি আমাকে তিন মাসের একটি ভিসা দিয়ে বাংলাদেশে পাঠান। এখন আমি আমার পরিবারকে কাছে পেয়ে খুবই আনন্দিত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *