পিতৃহত্যার আকট্য প্রমান চান এমপি কন্যা ডরিণ / লাশের খন্ডিত অংশ উদ্ধার থেকে পাবলিক টয়লেটে ফ্লাশের গল্প / তারপর কি ?
\ আসিফ কাজল, ঝিনাইদহ থেকে \
ঝিনাইদহের সরকারদলীয় সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনারের হত্যা নিয়ে দিন যতই গড়াচ্ছে ততই রহস্য ও সংকট ঘনীভুত হচ্ছে। বিশেষ করে ১৪ দিনেও লাশ না পাওয়ায় বিষয়টি এখন সংশয় থেকে সন্দেহ ও অবিশ^াসে পরিণত হয়েছে। ইতিমধ্যে এমপি কন্যা মুমতারিন ফেরদৌস ডরিণ মঙ্গলবার (২৮ মে) হতাশ হয়ে পিতৃহত্যা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তিনি বলেছেন তার পিতাকে যে হত্যা করা হয়েছে তার প্রমান কি ? এছাড়া গণমাধ্যমে তার পিতাকে নিয়ে পুলিশ প্রশাসনের বরাত দিয়ে একেক সময় একেক বক্তব্য আসায় তিনি ক্ষুদ্ধ ও মর্মাহত। তিনি বলেন খুনের এতোদিন পরও আমরা সুনির্দিষ্ট কোন তথ্য প্রমান পেলাম না। তিনি অভিযোগ করেছেন, হত্যার ঘটনা ধামাচাপা দিতে ও ভিন্নখাতে প্রবাহিত করে তার পিতার অন্ধকার জগৎ নিয়ে মিথ্যা নিউজ করা হচ্ছে। শুধু এমপি কন্যা নয়, কালীগঞ্জের বিপুল সংখ্যক আনার সমর্থক ও দলীয় নেতাকর্মীরাও গোটা বিষয়টিকে ‘ধু¤্রজাল’ বলছেন। মুমতারিন ফেরদৌস ডরিণ নিজ বাসভবনের সামনে গণমাধ্যমে বক্তব্য দিতে গিয়ে বলেন, ৫ কোটি টাকা দিয়ে তাকে হত্যা করা হয়েছে বলে খবর বেরিয়েছে। কিন্তু এই টাকা কার? মুল পরিকল্পকারীকে এই টাকা কে দিল? এসব জানা দরকার বলে ডরিণ সাংবাদিকদের জানান। তিনি বলেন, তার পিতাকে আগে আরো দুইবার হত্যার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। তৃতীয়বার তারা সফল হয়। আসামীরা নিজেরাই স্বীকার করেছে ২০২৪ সালে সংসদ নির্বাচনের আগে একবার হত্যার ছক কষে তারা। ফলে এটা রাজনৈতিক হত্যাকান্ডও হতে পারে। এখন ঘটনা ভিন্নখাতে নিয়ে বিভ্রন্তিমুলক সংবাদ ছাপা হচ্ছে। মুল পরিকল্পনাকারীকে না ধরা পর্যন্ত আমি আমার সন্দেহের কথা বলতে পারছি না বলেও ডরিণ জানান। ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক সাইদুল করিম মিন্টু কালীগঞ্জে এমপি আনারের পরিবারকে শান্তনা দিতে গিয়ে বলেন, “কি কারণে এমপি আনার খুন হয়েছেন তা মুল পরিকল্পনাকারীকে না ধরতে পারলে বলা যাচ্ছে না। তবে তিনি আশাবাদী যে ডিবি এ বিষয়ে খুবই আন্তরিক। তারা সঠিক জিনিসটা দ্রæত জনসমক্ষে আনতে পারবেন”। এমপি আনারের ঘনিষ্ট হিসেবে পরিচিত স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান ওহিদুজ্জামান ওদু জানান, আমরা মুলত ধু¤্রজালের মধ্যে আছি। আমাদের নেতা যদি মারা যান তবে তার পরিপুর্ণ আলামত বা লাশ দেওয়া হোক। আমরা তাকে দাফন-কাফন করি। কালীগঞ্জ পৌরসভার মেয়র ও এমপি আনারের ভাগ্নে আশরাফুল আলম বলেন, “আমরা এখন লাশের অপেক্ষায় আছি। আমরা লাশটা পেলে যাতে জানাজা ও দাফনটা করতে পারি”। এমপি আনারের ঘনিষ্ট সহযোগী ও কালীগঞ্জ উপজেলা পরিষদের নবনির্বাচিত চেয়ারম্যান শিবলী নোমানী জানান, এ পর্যন্ত প্রশাসনের উর্ধ্বতন কর্মকর্তা এমনকি দলের কেন্দ্রীয় নেতারা শোকাহত আনারের পরিবারকে শান্ত দিতে এসেছেন কিনা তা তার জানা নেই। তবে স্থানীয় ইউএনও ও ওসি আনারের বাড়িতে এসেছিলেন বলে তিনি জানান। জেলা আ’লীগের শ্রমবিষয়ক সম্পাদক ও কালীগঞ্জ পৌরসভার সাবেক মেয়র জানান, আনার হত্যা নিয়ে তারা অস্পষ্টতার মধ্যে রয়েছেন। কি হচ্ছে আর কি হবে তা বুঝে উঠতে পারছেন না। তিনি বলেন দুই দেশের গোয়েন্দারা এ নিয়ে কাজ করছেন, কিন্তু ১৪ দিনেও দৃশ্যমান কোন ফলাফল নেই। এদিকে কালীগঞ্জের সাধারণ নেতাকর্মীরা বলছেন, এমপি আনার কালীগঞ্জ, ঝিনাইদহ, কোটচাঁদপুর ও মহেশপুরে হাজার হাজার মানুষের জানাজায় শরীক হয়েছেন। মৃত্যুর কথা শুনলেই দল বেদল না দেখে ছুটে গেছেন তাদের বাড়ি। অথচ এখন আমরা তার জানাজা পড়তে পারছি না। কালীগঞ্জের নেতারা একটি কথায় বারবার তুলে ধরছেন, তা হলো যে ভাবেই হোক লাশের খন্ডিত অংশ বা টুকরো উদ্ধার। ১৪ দিনেও আনারের দেহের কোন অংশ উদ্ধার তো নয়ই বরং দিনকে দিন নতুন নতুন চকটদার তথ্য উদ্ধারের কথা বলা হচ্ছে। প্রথমে তো কলকাতার সঞ্জিভা গার্ডেন থেকে লাশের খন্ডিত অংশ ও রক্ত মাখা জামাকপড় উদ্ধারের কথা মিডিয়ায় ছড়িয়েছি। কিন্তু ভারত-বাংলাদেশের গোয়েন্দারা এ সব প্রমান বাস্তবে প্রকাশ করতে পারেনি। আর লাশের টুকরো ও জামাকাপড় না পাওয়া গেলে হত্যার কাজে ব্যবহৃত ধারালো অস্ত্রই বা কোথায় গেল ? এসব প্রশ্নের সমাধান হতে না হতেই মঙ্গলবার বাংলাদেশের ডিবি প্রধান হারুন অর রশিদ কলকাতার নিউটাউনের ওয়েস্টিন হোটেল নতুন তথ্য দিয়েছেন। তিনি বলেছেন বাথরুমে নিয়ে এমপি আনারকে টুকরো টুকরো করে টয়লেটে ফ্লাশ করা হতে পারে। প্রয়োজনে সুয়ারেজ ড্রেনে অভিযান চালাবে গোন্দোরা। তিনি আরো বলেছেন, একজন জীবন্ত মানুষ (এমপি আনার) সঞ্জীবা গার্ডেনসে ঢুকছেন, সেই নারীও ঢুকলেন, তার ডিজিটাল এভিডেন্স রয়েছে। কিন্তু মাননীয় এমপি ওই আবাসন থেকে বেরোলেন না, তারও প্রমাণ রয়েছে। আবার সন্দেহভাজন কিছু ব্যক্তিকে বের হতে দেখা গেছে। ডিবি প্রধান বলেন, আমার মনে হয়, ভারত এবং বাংলাদেশের অভিজ্ঞ কর্মকর্তারা ঘটনার পারিপার্শ্বিকতা, ডিজিটাল এভিডেন্স, আসামিদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি, পিসিপিআর (প্রিভিয়াস কনভিকশন অ্যান্ড প্রিভিয়াস রেকর্ড) এই বিষয়গুলো আমলে আনবেন। এরপর আদালতে প্রেরণ করা হলে সেখানেও বিষয়টি আমলে নেবেন। সেক্ষেত্রে এই হত্যাকান্ডের বিচার করা কষ্টকর হবে বলে আমি মনে করি না। এদিকে আনার হত্যার ১৪ দিন পার হলেও আওয়ামীলীগের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ বা ঝিনাইদহ জেলা প্রশাসনের উর্দ্ধতন কর্মকর্তারা তার শোক সন্তপ্ত পরিবারকে শান্তনা দিতে কালীগঞ্জে আসেননি। এ নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে। কেন যাননি এ নিয়ে আলোচনায় নানা ডালপালা গজাচ্ছে কালীগঞ্জ শহরে। অনেকে মনে করেন বাংলাদেশ ও ভারতীয় মিডিয়ায় এমপি আনোয়ারুল আজিম আনরকে যে ভাবে উপস্থাপন করেছ তাতে আ’লীগ ও প্রশাসন উভয়ই বিব্রত। যেকারণে শেকাহত পরিবারের পাশে তারা কেউ আসননি। বিষয়টি নিয়ে আনারের ব্যক্তিগত সহকারী জানিয়েছেন, ঘটনার পর থেকে এমপির পরিবার ঢাকায় ছিল এবং খোদ প্রধানমন্ত্রীর সান্নিধ্য পেয়েছেন। এ কারণেই হয়তো কেন্দ্রীয় নেতারা কালীগঞ্জ আসেননি। উল্লেখ গত ১২ মে চুয়াডাঙ্গার দর্শনার গেদে সীমান্ত দিয়ে ভারতে যান এমপি আনার। ওঠেন পশ্চিমবঙ্গে বরাহনগর থানার মন্ডলপাড়া লেনে বন্ধু গোপাল বিশ্বাসের বাড়িতে। পরদিন ১৩ মে কথিত ডাক্তার দেখানোর কথা বলে আনার বের হন। এরপর থেকেই রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ হয়ে যান এমপি আনোয়ারুল আজীম আনার। নিখোঁজের বিষয়ে একটি জিডিও করেন বন্ধু গোপাল বিশ্বাস। এরপরও খোঁজ মেলে না তিনবারের এই সংসদ সদস্যের। বুধবার (২২ মে) হঠাৎ খবর ছড়ায়, কলকাতার পার্শ্ববর্তী নিউটাউন এলাকায় বহুতল সঞ্জীবা গার্ডেনস নামে একটি আবাসিক ভবনের বিইউ ৫৬ নম্বর রুমে আনার খুন হয়েছেন। ঘরের ভেতর পাওয়া যায় রক্তের ছাপ। তবে ঘরে মেলেনি মরদেহ। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত কলকাতায় একজন ও বাংলাদেশে তিনজন গ্রেফতার হয়েছেন। তারা হত্যাকান্ডের বিষয়ে বিভিন্ন তথ্য দিলেও মরদেহ উদ্ধারের জট খোলেনি। উদ্ধার হয়নি আনারের ব্যবহৃত জামাকাপড় ও ব্যাগ। লাশ টুকরো করার কাজে নিয়োজিত কসাই জিহাদ আটক হলেও হত্যার কাজে ব্যবহৃত ধারালো অস্ত্র উদ্ধার অধরাই রয়ে গেছে।