ফেসবুকের অশ্লীল ভিডিওতে ডুবছে যুবসমাজ, বিপথগামী হচ্ছে স্কুল কলেজ শিক্ষার্থীরা

Share Now..

এস আর নিরবঃ
স্মার্ট ফোন যাদের আছে; ফেসবুক ব্যবহার করে না এমন লোক খুঁজে পাওয়া কঠিন। অনেকে তথ্য আদান প্রদানে সামাজিক যোগাযোগের এ মাধ্যমটি কাজে লাগান। স্বজনদের সাথে এক সাথে বসে ফেসবুক ব্যবহার করে সময় কাটান। কিন্তু ফেসবুকের অন্যতম একটি অপশন ‘ওয়াচ ভিডিও’ অনেক ব্যবহারকারীর জন্য বিপত্তির কারণ হয়ে উঠেছে। এই অপশনে ভালো ভিডিও দেখা শেষ হলেই অশ্লীলতা ঢুকে পড়ছে। পরিবার নিয়ে দেখার সময় এ রকম অশ্লীল ভিডিও সামনে আসায় লজ্জায় লাল হতে হচ্ছে। আবার কেউ কেউ হুমড়ি খেয়ে দেখছে এমন অশ্লীল ভিডিও। বিশেষ করে যুবসমাজের এমন ভিডিও দেখাকে বিপদজনক বলছেন বিশেষজ্ঞরা।

যশোর এম এম কলেজের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক হামিদুল হক শাহীন বলেন, মাদকের থেকেও বেশি ভয়ংকর অশ্লীল ভিডিও। এগুলোর মাদকতা এত বেশি যে একবার আসক্ত হয়ে পড়লে সহজে আর ছাড়া সম্ভব না। ইন্টারনেটে এইগুলোর সহজলভ্যতার কারণেই কিন্তু ধর্ষণ বেড়েছে। কারণ তরুণরা যখনই এ ধরনের ভিডিও দেখে তখন তাদের মধ্যে জৈবিক চাহিদার কাজ করতে থাকে এবং তারা অনেক সময় বন্ধুদের সাথে আলোচনাও করে। প্রতিনিয়ত এই ভিডিও দেখার কারণে তাদের মানসিক পরিবর্তন হতে শুরু করে। তখনই দলবদ্ধ ভাবে বা একা বিভিন্ন অপরাধের সাথে জড়িয়ে পড়ে। তিনি বলেন, বর্তমানে আমরা প্রযুক্তিতে অনেক এগিয়ে গেছি কিন্তু এর সুফল থেকে কুফল বেশি দেখা যাচ্ছে। যদি এখনই ইন্টারনেট ব্যবহারে নীতিমালা তৈরি না করা হয় তাহলে পরবর্তী প্রজন্ম শতভাগ মূর্খ হয়ে যাবে।

মাদকের থেকেও বেশি ভয়ংকর অশ্লীল ভিডিও। কেউ একবার আসক্ত হয়ে পড়লে সহজে ছাড়তে পারে না। ইন্টারনেটে এগুলোর সহজলভ্যতার কারণেই ধর্ষণ বেড়েছে– এমএম কলেজের সহকারী অধ্যাপক হামিদুল হক শাহীন

এ বিষয়ে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি অধিদপ্তর যশোরের প্রোগ্রামার আনিছুর রহমান জানান, ইন্টারনেট ব্যবহারে আমাদের অনেক বেশি সতর্ক হতে হবে। কারণ কেউ ফেসবুকে যখন কিছু অনুসন্ধান করে দেখার জন্য তখন ফেসবুক তার মার্কেটিং পলিসি অনুযায়ী ওই জাতীয় তথ্য, ভিডিও, ছবি ব্যবহারকারীর কাছে বেশি প্রদর্শন করে। এখন কেউ যদি অসতর্কতাবসত নুডি কোন কিছু সার্চ করে থাকে তাহলে ফেসবুক নুডি সম্পর্কিত অন্য সকল তথ্য তাকে সাজেস্ট করবে। এটা মার্কেটিং পলিসি। তবে বর্তমানে দেখা যাচ্ছে অনুসন্ধান না করা সত্ত্বেও অনেকের কাছে এই জাতীয় তথ্য বা ভিডিও প্রদর্শিত হচ্ছে এর কারণ নেটওয়ার্ক। হতে পারে সে যেই নেটওয়ার্ক চেইনের ভেতরে আছে ওই চেইনের কেউ এমন কিছু সার্চ করেছে। তাই তার কাছেও এটি প্রদর্শিত হচ্ছে। তাই আমাদের সকলকেই ইন্টারনেট ব্যবহারে অনেক বেশি সচেতন হতে হবে।

বিটিআরসির মিডিয়া এন্ড পাবলিকেশন্স উইংয়ের উপ-পরিচালক জাকির হোসেন খান বলেন,সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও ওয়েবসাইটে আপত্তিকর কনটেন্ট সরানো ও সার্বক্ষণিক নজরদারিতে বিশেষ সেল সার্বক্ষনিক কাজ করে চলেছে। ফেসবুকসহ অন্যান্য সামাজিক মাধ্যম ও ইন্টারনেট ২৪ ঘণ্টা নজরদারিতে রাখা হচ্ছে। তবে নিয়ন্ত্রক সংস্থা ইচ্ছা করলেই কোন কনটেন্ট সরিয়ে ফেলতে পারে না। বড় জোর অনুরোধ করতে পারে। সিদ্ধান্ত নেয় স্যোশাল মিডিয়া কর্তৃপক্ষগুলো।

কেউ ফেসবুকে যখন কিছু অনুসন্ধান করে তখন ফেসবুক তার মার্কেটিং পলিসি অনুযায়ী এ জাতীয় তথ্য, ভিডিও, ছবি ব্যবহারকারীর কাছে বেশি প্রদর্শন করে। -তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি অধিদপ্তর যশোরের প্রোগ্রামার আনিছুর রহমান

তিনি জানান, গত এক বছরে ১৮ হাজার ৮৩৬টি ‘আপত্তিকর’ ফেসবুক লিংক বন্ধ করার অনুরোধ জানায় বাংলাদেশ সরকার। এর মধ্যে চার হাজার ৮৮৮ টি লিংক বন্ধ করা হয়েছে।

৪৩১টি ইউটিউব লিংক বন্ধ করার অনুরোধে ৬২টি ক্ষেত্রে ইউটিউব কর্তৃপক্ষ সাড়া দিয়েছে। তবে চাইলে যে কোনো ওয়েবসাইট বাংলাদেশ থেকে দেখার সুযোগ বন্ধ করে দিতে পারে বিটিআরসি। এক হাজার ৬০টি ওয়েবসাইটের লিংক গত এক বছরে বন্ধ করা হয়েছে।
ভুক্তভোগীরা কী বলছেন?

ফেসবুক আমাদের সবার জীবনে এমনভাবে জায়গা করে নিয়েছে যে সুযোগ পেলেই আমরা ব্যবহার করছি। তবে বর্তমানে ফেসবুকে ভিডিও দেখার প্রবণতা আমাদের বেড়েছে। এতে কখনো কখনো মুশকিলেও পড়তে হচ্ছে বলছিলেন ফল ব্যবসায়ী ফারুক আহমেদ। তিনি জানান, একদিন রাতে দুই সন্তানকে নিয়ে ফেসবুকে ভিডিও দেখছি। একটা ভিডিও শেষ হওয়ার পর হঠাৎ এমন অশ্লীল ভিডিও সামনে চলে আসলো যে বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে গেলাম। তাৎক্ষনিক মোবাইলের পাওয়ার বাটন চাপ দিয়ে বন্ধ করে রেখে দিতে হলো। তারপর থেকে সন্তানদের সামনে আমি আর ফেসবুক চালায় না।

রোকসানা আক্তার নামে একজন গৃহিনী বলেন, আমার দশ বছরের ছেলে অনেক সময় আমার মোবাইল নিয়ে ইউটিউব, ফেসবুকে ভিডিও দেখে। একদিন হঠাৎ আমি লক্ষ্য করলাম ও এমন কিছু দেখছে যে অশ্লীল শব্দ শোনা যাচ্ছে। সাথে সাথে আমি মোবাইল নিয়ে যখন বাচ্চাকে প্রশ্ন করলাম তখন সে জানালো হঠাৎ এই ভিডিওটা সামনে চলে আসছে। তারপর থেকে আমি ওর কাছে মোবাইল দিতে সংশয় বোধ করি। তিনি জানান, ফেসবুক আমাদের জীবনে এমনভাবে জড়িয়ে গেছে যে; চাইলেও আমরা বন্ধ করতে পারবো না। তবে অশ্লীল এই ভিডিও ও ছবির ব্যাপারে যদি ফেসবুক কর্তৃপক্ষ কার্যকরী কোন সিদ্ধান্ত নেয় সেটি খুবই ভালো হবে।

কলেজ পড়ুয়া পাঁচজন শিক্ষার্থী একসাথে ফেসবুকে ভিডিও দেখছে। ভিডিওটি শেষ হতেই এমন একটি ভিডিও সামনে চলে আসলো যে তাদের মুখ লজ্জায় লাল হয়ে গেলো। কারণ পাঁচজনের ভেতরে দুইজন ছিলো নারী। আর তাদের ভাষ্য মতে, ভিডিওটি ছিলো খুবই অশ্লীল। এ নিয়ে তাদের মাঝে ভুল বোঝাবুঝিও হয়েছিলো। এমনটা বলছিলেন যশোর সরকারি সিটি কলেজের শিক্ষার্থী রাফসান।

কর্তৃপক্ষকে গত এক বছরে ১৮ হাজার ৮৩৬টি ‘আপত্তিকর’ ফেসবুক লিংক বন্ধ করার অনুরোধ জানায় সরকার। এর মধ্যে চার হাজার ৮৮৮ টি লিংক বন্ধ করা হয়েছে।

বিটিআরসির মিডিয়া এন্ড পাবলিকেশন্স উইংয়ের উপ-পরিচালক জাকির হোসেন রাফসান জানান, প্রায় সময় ফেসবুকে অশ্লীল ভিডিও দেখা যায়। অনেক মেয়ে ফেসবুকে লাইভের মাধ্যমে অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি করে নোংরা কথা বলে। আর সেইটা তরুণদের পাশাপাশি বয়স্কওরা দেখে। তিনি বলেন, অশ্লীল ভিডিও ও ছবির কারণে বর্তমান তরুণদের মানসিক ও নৈতিক অবক্ষয় হচ্ছে।

গবেষকেরা সতর্ক করে বলছেন, ফেসবুক ব্যবহারকারীদের নগ্ন ভিডিও দেখার সুযোগ করে দেওয়ার নামে যে স্ক্যামটি ছড়িয়েছে, তা ভাইরাস। সম্প্রতি ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া এই স্ক্যামটির কারণে ২০ লাখ ব্যবহারকারী ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন।

ইন্টারনেটের তথ্য অনুযায়ী রোমানিয়ার অ্যান্টি ম্যালওয়্যার কোম্পানি বিটডিফেন্ডার জানিয়েছেন, ট্রোজান ডট ফেকফ্ল্যাশ ডট নামের এই ম্যালওয়্যারটি ছড়িয়ে পড়ার আগে ফেসবুকের বিজ্ঞাপন পেজে প্রথম দেখা গিয়েছিল। এ সময় এই স্ক্যামটি বন্ধুর নামের ব্যক্তিগত ছবি বা বন্ধুর নগ্ন ভিডিও প্রভৃতি টাইটেলে প্রদর্শিত হয়। এ ধরনের লিংকে যখন ক্লিক করা হয়, তখন একটি বয়সের ভেরিফিকেশন চাওয়া হয়। এই ভেরিফিকেশন অংশটি এড়িয়ে ভিডিওতে গেলে অ্যাডোবি ফ্ল্যাশ প্লেয়ার ক্রাশ করে এবং পুনরায় ইনস্টল করতে হয়। ভাইরাসপূর্ণ ভুয়া ইউটিউব পেজটি তখন ব্রাউজারে একটি এক্সটেনশন হিসেবে যুক্ত হয়ে যায় এবং ব্যবহারকারীর ফেসবুক ফটোর মাধ্যমে অন্যদের কাছেও ছড়িয়ে যায়।

ফেসবুকে তাই অশ্লীল ছবি বা ভিডিও লিংকে ক্লিক করা থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দিয়েছেন অনলাইন নিরাপত্তা গবেষকেরা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *