বেকারত্বের ভয়াল থাবায় তিন বছরে ২৪ হাজার মানুষের বিদেশ পাড়ি
কর্মের সন্ধানে বিদেশ ছুটছেন ঝিনাইদহের মানুষ

Share Now..


আসিফ কাজল, ঝিনাইদহঃ
শিল্পে অনুন্নত ঝিনাইদহ জেলা থেকে বিদেশ যাওয়ার প্রবণতা ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। এই জেলা থেকে প্রতি মাসে শত শত বেকার যুবক কর্মসংস্থানের জন্য পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পাড়ি দিচ্ছেন। ফলে পাসপোর্ট অফিস, জেলা কর্মসংস্থান ও জনশক্তি অফিস, প্রবাসি কল্যান ব্যাংক ও কারীগরি প্রশিক্ষক কেন্দ্রে প্রতিদিন শিক্ষিত, অর্ধশিক্ষত ও নিরক্ষর বেকার যুবকরা ধর্না দিচ্ছেন। বাংলাদেশে কর্মসংস্থানের অভাব এবং দারিদ্রতার কারণেই অনেকে বিপদজনক পথ পাড়ি দিয়ে উন্নত দেশে যাওয়ারার পথ বেছে নিচ্ছেন বলেও অভিযোগ। এতে অনেকের অকাল মৃত্যু ঘটছে। তথ্য নিয়ে জানা গেছে, ২০১৫ সালের পর থেকে এ পর্যন্ত হরিণাকুন্ডু ও ঝিনাইদহ সদর থানার বিভিন্ন গ্রাম থেকে অন্তত ২৫ জন মানুষ সাগর পাড়ি দিয়ে বিদেশে যাওয়ার পথে নিখোঁজ হওয়ার তথ্য আছে। এর মধ্যে হরিণাকুন্ডুর চাঁদপুর ও সড়াবাড়িয়া গ্রামের ৮জন ও সদর উপজেলার রামচন্দ্রপুর গ্রামের ৩ জন, পিরোজপুর গ্রামের দুইজন, মিয়াকুন্ডু গ্রামের ৪জন, মহামায়া ও গাড়ামারা গ্রামের ৮ জনসহ একাধিক যুবক। হরিণাকুন্ডুর শ্রীফলতলা গ্রামের নাবাব আলী শিকদার কলেজে পড়তেন। কিন্তু চোখে মুখে তার চাকরী না পাওয়ার হতাশা ছিল। মনস্থির করেন বিদেশে যাবেন। ঝিনাইদহ কর্মসংস্থান ব্যাংক থেকে ঋন নিয়ে তিনি এখন সৌদি আরবের একটি কোম্পানীতে চাকরী করছেন। নবাব আলীর মতো বংকিরা গ্রামের সুজন বিশ^াস, আব্দুল আলীম ও রোকনুজ্জামানও পাড়ি দিয়েছেন বিদেশে। আব্দুল আলীম জানিয়েছেন, দ্রব্যমুল্যের উর্ধ্বগতির সঙ্গে আয় রোজগারের মিল ছিল না। ফলে স্ত্রী সন্তান নিয়ে খুব কষ্টে ছিলাম। প্রবাসি কল্যান ব্যাংক থেকে ঋন নিয়ে তিনি এখন সৌদি আরব রয়েছেন। ঝিনাইদহ জেলা কর্মসংস্থান ও জনশক্তি অফিসের সহকারী পরিচালক সবিতা রানী মজুমদার জানান, বর্তমান বিদেশ গমনেচ্ছুদের মধ্যে মালয়েশিয়া ও সৌদি আরবে যাবার প্রবনতাই বেশি। তিনি বলেন, করোনা মহামারির আগ পর্যন্ত ঝিনাইদহ জেলা থেকে বিদেশে প্রায় ৮০ হাজার মানুষ গেছেন। করোনার কারণে দুই বছর কিছুটা কম ছিল। ১২ ডিসেম্বর ২০২২ পর্যন্ত ঝিনাইদহ জেলার এক লাখ চার হাজার ১২৩ জন নাগরিক বিদেশে অবস্থান করছেন। এর মধ্যে ৮৪ হাজার ৫৩৩ জন পুরুষ ও ৯ হাজার ৫৯০ জন নারী রয়েছে। তিনি বলেন, করোনায় সংক্রামনের মাত্রা কমে আসায় গত তিন বছরে চব্বিশ হাজার মানুষ বিদেশে গেছেন। এর মধ্যে বেশির ভাগ মানুষ কাজ নিয়ে মালয়েশিয়া গেছেন। বাংলাদেশের আবহাওয়ার সঙ্গে মিল থাকায় কৃষি ও বাগানের কাজ নিয়ে জেলার মানুষ মালয়েশিয়ায় বেশি যাচ্ছেন। গতকাল সোমবার অফিসটিতে দেখা গেছে কয়েক’শ বেকার যুবক ফিঙ্গার দিতে এসেছেন। ঝিনাইদহ আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের অতিরিক্ত পরিচালক সাখওয়াত হোসেন জানান, প্রতিদিন ঝিনাইদহ জেলা থেকে শতাধিক মানুষ পাসপোর্টের জন্য আবেদন করছেন। এই হার মাসে প্রায় তিন হাজারেরও বেশি বলে তিনি জানান। পাসপোর্টকৃতদের মধ্যে চিকিৎসা বা পড়ালেখার পাশাপাশি বেশির ভাগ যুবক বিদেশে চাকরীর জন্য আবেদন করছেন। এদিকে বেকার যুবকদের ভিসা প্রাপ্তি সাপেক্ষে ঋন সুবিধা দিচ্ছে ঝিনাইদহ প্রবাসি কল্যান ব্যাংক। ভিসা ও জনশক্তি কর্মসংস্থান প্রশিক্ষন ব্যুারের (বিএমইটি) স্মার্ট কার্ড থাকলে দরিদ্র বেকার যুবকদের বিদেশ যাওয়ার পুরো টাকা বহন করে থাকে প্রবাসি কল্যান ব্যাংক। বিষয়টি নিয়ে ঝিনাইদহ প্রবাসি কল্যান ব্যাংকের ব্যাবস্থাপক এসকে সেফাতি জানান, ঝিনাইদহ জেলায় প্রবাসি কল্যান ব্যাংকের শাখা স্থাপিত হওয়ার পর থেকে চার বছরে প্রায় এক হাজার আটশ যুবকে ঋন সুবিধা প্রদান করা হয়েছে। সে হিসেবে প্রায় ২০ কোটিরও বেশি টাকার ঋন দেয়া হয়েছে। বিদেশ গিয়ে যুবকরা প্রতি মাসেই ব্যাংকের কিস্তি পরিশোধ করছেন বলে তিনি জানান। ঝিনাইদহ কারিগরি প্রশেক্ষন কেন্দ্রের (টিটিসি) অধ্যক্ষ রুস্তম আলী জানান, এই প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে থেকে বেকার যুবকদের দক্ষ হিসেবে গড়ে তোলা হচ্ছে। এখান থেকে স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদী প্রশিক্ষন নিয়ে যুবকরা বিদেশে যাচ্ছেন। তিনি বলেন ২০০৬ সালে ঝিনাইদহ কারিগরি প্রশেক্ষন কেন্দ্রেটি চালু হওয়ার পর থেকে ১০টি ট্রেডে দক্ষতা উন্নয়নমুলক প্রশিক্ষন দেয়া হচ্ছে। ওয়ার্কার হিসেবে যারাই বিদেশে যাবেন, তাদেরই টিটিসি থেকে প্রশিক্ষন নিতে হবে, এটা বাধ্যতামুলক। কারিগরি প্রশেক্ষন কেন্দ্রে থেকে যারাই প্রশিক্ষন গ্রহন করবেন তারা বেকার থাকবে না বলেও জানান অধ্যক্ষ রুস্তম আলী। ঝিনাইদহের মানবাধিকার কর্মী অধ্যক্ষ আমিনুর রহমান টুকু বলেন, সাধারণত স্কুলের গন্ডি পেরনো বেকার যুবকদের মাঠের কাজ ছাড়া রুজির রাস্তা না থাকায় বাধ্য হয়ে তারা বিদেশে যাচ্ছেন। এই সুযোগে দালাল-যোগে বিদেশ পাড়ি দিয়ে দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন অনেকেই। বিদেশে কাজ করতে গিয়ে অনেকে ভাল রোজগার করে ফেরেন ঠিকই, কিন্তু অনেককে আবার প্রতারক দালালদের পাল্লায় পড়ে নিঃস্ব হতে দেখা যায়। তবে এখন অবৈধ পড়ে বিদেশ যাওয়ার প্রবণাতা কমে এসেছে। সরকারী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান অনলাইনে রেজিষ্ট্রেশন করায় দালালদের দৌরাত্ম্য কমতে শুরু করেছে।

One thought on “বেকারত্বের ভয়াল থাবায় তিন বছরে ২৪ হাজার মানুষের বিদেশ পাড়ি<br>কর্মের সন্ধানে বিদেশ ছুটছেন ঝিনাইদহের মানুষ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *