বৈশাখ শুধু উৎসবের নয়, বাঙালিত্বের ঠিকানা
পহেলা বৈশাখ উদ্যাপন এখন বাংলাদেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে ছড়িয়ে পড়েছে সারা বিশ্বে। প্রতিটি বাঙালি দিনটিকে উদ্যাপন করে উৎসবের আমেজে। নতুন পোশাক পরে সবাই মিলিত হন সাংস্কৃতিক আয়োজনে। ছায়ানট রমনার বটমূলে বর্ষবরণের যে প্রভাতি অনুষ্ঠান শুরু করেছিল তা আজ বিশ্ব জুড়ে বর্ষবরণের প্রতীক হয়ে উঠেছে।
অপরদিকে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের অয়োজনে মঙ্গল শোভাযাত্রার মাধ্যমে নতুন বছরকে আবাহনের যে ধারা সৃষ্টি হয়েছে তাকে ইউনেসকো বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। সাধারণ চোখে এ দুটি অনুষ্ঠানকে গানের অনুষ্ঠান বা লোকজ মোটিফ নিয়ে নিছক শোভাযাত্রা মনে করলে ভুল হবে। বাংলাদেশের মানুষের কাছে এ দুটি আয়োজনের গুরুত্ব ভিন্ন।
স্বাধিকার আন্দোলনের সময় ছায়ানটের গানে গানে যে প্রতিবাদের ধারা সৃষ্টি করেছিল তা মুক্তি সংগ্রামের প্রেরণার পথে বড় শক্তি যুগিয়েছে। শুধু তাই নয়, আমাদের মূল পরিচয় যে বাঙালি সেটাও উপলব্ধি করতে পেরেছিল। একইভাবে মঙ্গল শোভাযাত্রাও সূচিত হয়েছিল এরশাদবিরোধী আন্দোলনে তরুণদের স্বতঃস্ফূর্ত মঙ্গল প্রত্যাশা থেকে।পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী রবীন্দ্র সংগীত গাওয়া নিষিদ্ধ করে। পাকিস্তানি শাসনামলে যখন ধর্মের ধুয়ো তুলে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করল—তখন পাকিস্তানি এ অপশাসনকে অগ্রাহ্য করে বাঙালি সংস্কৃতিকে জাতির জীবনে ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠা পায় ছায়ানট। বাঙালি সংস্কৃতিকে জাতীয় জীবনে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য নানা উদ্যোগ গ্রহণ করে তারা। পহেলা বৈশাখ উদ্যাপন হয়ে উঠেছিল একটি আন্দোলন। সেই গান গাওয়ার মধ্য দিয়ে যে বিদ্রোহের সূত্রপাত ঘটেছিল, রমনা বটমূলে তা পেরিয়ে এলো বায়ান্নটি বছর।
উত্সবের আশ্রয়ে প্রতিবাদের উন্মেষ ঘটেছিল ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে। রাজধানীবাসীর কাছে পহেলা বৈশাখে ছায়ানটের অনুষ্ঠান আর পহেলা বৈশাখ উদ্যাপন এখন সমার্থক হয়ে উঠেছে। গানের সুরে নতুন দিনের সূর্যকে বরণ করার জন্য ছায়ানট যে সূচনা করেছে—সারা দেশের মানুষের কাছে, বাঙালির কাছে এখন সেটাই পরিণত হয়েছে বৈশাখবরণের প্রথায়। এখন তো বিশ্ব জুড়েই একই আদলে অসংখ্য অনুষ্ঠান হচ্ছে। পহেলা বৈশাখ নতুন বাংলা বছরের শুরুর দিনটি তাই বাংলাদেশের মানুষের কাছে ভিন্ন একটি তাত্পর্য নিয়ে উপস্হিত হয়। নিছকই উত্সব উদ্যাপন নয়। উত্সবের আশ্রয়ে জাতির জীবনে প্রতিবাদের উন্মেষ ঘটায় পহেলা বৈশাখ। পাকিস্তানি শাসকদের বিরুদ্ধে যেমনটা হয়েছিল, স্বৈরশাসক এরশাদের বিরুদ্ধে যেভাবে প্রতিবাদ জানিয়েছিল, ২০০১ সালে ছায়ানটের অনুষ্ঠানে বোমা বিস্ফোরণের পরে যেমন মৌলবাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে— ছায়ানট যেন মানবতার পক্ষে লড়াইয়ে তাদের স্হির প্রত্যয়ের কথাই ব্যক্ত করছে বারবার। সংগীতের সুরে সেই আন্দোলন ঢাকার গণ্ডি ছাড়িয়ে সারা দেশে আলোড়ন তুলেছিল। আজ সেই আলোড়ন পরিণত হয়েছে প্রতিটি বাঙালির প্রাণের উত্সবে।
এ প্রসঙ্গে সন্জীদা খাতুন বলেন, ১৯৬৭ সালে পহেলা বৈশাখ উদ্যাপনের মধ্য দিয়ে বাঙালি উপলব্ধি করতে পারে যে, এটা আমাদের নববর্ষ। আমরা যে বাঙালি একথা বলার সাহস তখন ছিল না। মানুষের মনে ভীতি ছিল। পহেলা বৈশাখ উদ্যাপনের মধ্য দিয়ে সে ভীতি মানুষের মন থেকে কেটে গেল। বাঙালির সাংস্কৃতিক বোধ জেগে উঠতে শুরু করল।
তিনি জানান, সেই পরাধীনতার আমল থেকে নববর্ষের আবাহনী করে আসছি। তখন প্রাণে স্বতঃস্ফূর্ততা ছিল। সেই উচ্ছ্বাসে ২০০১ সালে আঘাত আসে। বোমা হামলা হয়। এরপর ছায়ানট নিরাপত্তা বেষ্টনীতে আবদ্ধ হয়ে পড়ে। এই হিংসাত্মক আচরণ মানুষের স্বাভাবিক আচরণ নয়। এই হিংসা অশিক্ষা থেকে এসেছে। মুখস্ত করে খাতায় উগরে দিলে তা শিক্ষা হয় না। সত্যিকারের শিক্ষার জন্য সংস্কৃতির সঙ্গে যোগ অপরিহার্য। এ পথেই উদ্ধার সম্ভব। শিক্ষার সঙ্গে সংস্কৃতির যোগ না ঘটলে এদেশ থেকে অজ্ঞানতা, অজ্ঞতা দূর হবে না। অন্তর থেকে অজ্ঞানতার অন্ধকার দূর হলেই আমরা মানুষ হতে পারব। হতে পারব সম্পূর্ণ বাঙালি।’
বাংলা নববর্ষ বা পহেলা বৈশাখ উদ্যাপন বাঙালির প্রাচীনতম ঐতিহ্য। পহেলা বৈশাখে নতুনকে গ্রহণ করার, পুরোনোকে মুছে ফেলে সামনে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা গ্রহণ করা হয় উত্সব পালনের মধ্য দিয়ে। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বাংলাদেশে এই নববর্ষ উদ্যাপন পরিণত হয়েছে সর্বজনীন উত্সবে। আবহমানকাল ধরে বাংলার ঘরে ঘরে পালিত হচ্ছে বর্ষবরণের এ উত্সব। হিন্দু—মুসলিম, বৌদ্ধ—খ্িরষ্টান মিলিত বাঙালি জাতির একান্ত এ উত্সবে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করে আসছে সবাই।