যশোরে নিত্যপণ্যের লাগামছাড়া দাম, ভোক্তা মহলে ক্ষোভ
\ যশোর জেলা প্রতিনিধি \
যশোরে সবজিসহ সব নিত্যপণ্যের দাম লাগামহীন। সেই সাথে সরবরাহ কমেছে কাঁচা মরিচের। ১০ দোকান ঘুরে একটিতে পাওয়া গেলেও বিক্রি হচ্ছে ৪শ টাকা কেজি। দু’একটি দোকানে শুকিয়ে চিমটে হওয়া কাঁচা ঝাল ৯৫ টাকা পোয়া বিক্রি হতে দেখা গেছে। এক সাথে পাল্লা দিয়ে সব নিত্যপণ্যের দাম আকাশচুম্বী হওয়ায় ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছেন ভোক্তা মহল। এক বেনাপোল বন্দর দিয়ে ৩ দিনে ভারত থেকে কাঁচা মরিচ এসেছে ৮০৬ মেট্রিকটন কিন্তু এতো ঝাল কোথায় গেল-জানা নেই কারোর। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার বিকেলে যশোর জেলা প্রশাসন ও ভোক্তা অধিকার যৌথভাবে ডিমের দোকানে অভিযান চালায়। বেশি দামে বিক্রির কারণ খুঁজতে তারা খুচরা বিক্রেতাদের ক্রয় রশিদ দেখেন। তবে উৎপাদন ও বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো কেন বেশি দাম নিচ্ছে তা খতিয়ে দেখছে কিনা প্রশাসন তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। ভোক্তা মহলের অভিযোগ বাজার মনিটরিং যেভাবে হওয়া দরকার, সেভাবে হচ্ছে না। ফলে সিন্ডিকেট বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। যার প্রভাব পড়েছে ভোক্তা মহলের ওপর। বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে ৩ দিনে ৮০৬ টন কাঁচা মরিচ আমদানি সত্তে¡ও পণ্যটির দাম কমেনি। জেলার বিভিন্ন খুচরা বাজারে কাঁচা মরিচ বিক্রি হচ্ছে ৪০০ টাকার উপরে। পাড়া-মহল্লার দোকানে দাম আরও বেশি। শনিবার (১৯ অক্টোবার) সন্ধ্যায় যশোর বড়বাজারের বরফকল এলাকা, এইচএম সড়ক (মন্দির সংলগ্ন) হাটচান্নি বাজার ঘুরে দেখা যায়-অধিকাংশ সবজির দোকানে কাঁচা মরিচ নেই। ১০/১২ টা দোকান ঘুরে একটিতে কাঁচা মরিচের দেখা মিলেছে। তরতাজা কাঁচা মরিচের পোয়া অর্থাৎ ২৫০ গ্রাম বিক্রি হচ্ছে ৫০ টাকা। তকে কিছু দোকানে শুকিয়ে যাওয়া মরিচ ৯৫ টাকা পোয়া বিক্রি হতে দেখা গেছে। এ নিয়ে কথা বলতে নারাজ দোকানীরা। তবে বেনাপোল দিয়ে ৩ দিনে যে ৮০৬ মেট্রিক টন কাঁচা মরিচ কই গেল জানতে চাওয়া হলে আব্দুল গফুর নামে এক ভোক্তা বলেন-সব ‘শয়তানের পেটে গেছে। খোদ বেনাপোল চেকপোস্ট বাজারে কাঁচা মরিচের পোয়া বিক্রি হচ্ছে ৯০ থেকে ১০০ টাকা পোয়া। কাঁচা মরিচ কিনতে আসা রেজাউল করিম বলেন, আমরা জাস্ট কিছু বলার নেই। ক্ষোভ ঝেড়ে এই ভোক্তা বলেন-দেশ কারা চালাচ্ছে, কিভাবে চালাচ্ছে, তাদের বাজারে কেনাকাটা করতে হয় কি-না, তা জানার কৌতুহল আছে কিন্তু সে পর্যন্ত যাওয়ার উপায় খুঁজে পাচ্ছি না। যশোর শহরের বড় বাজারে সবজি বিক্রেতা দীপক সাহা জানান, প্রচুর বৃষ্টিপাতের কারণে দেশি মরিচের গাছ নষ্ট হয়ে গেছে। আর পূজার ছুটির কারণে বন্দর কয়েকদিন বন্ধ থাকায় সরবরাহে ঘাটতি দেখা দিয়েছে। যে কারণে আজও বাজারে কাঁচা মরিচ বিক্রি হচ্ছে ৪০০ টাকা কেজিতে। খুচরা ব্যবসায়ীরা জানান, আমদানি বাড়লেও আড়তে তেমন কমেনি কাঁচা মরিচের দাম। তাদের দাবি টানা ৫ দিন বন্দর বন্ধ থাকার পর ১৬ অক্টোবার পর্যন্ত ৮০৬ মেট্রিক টন কাঁচা মরিচ আমদানি হয়েছে বলে শুনেছি কিন্তু আদতে দাম কম নেই। যেকারণে অধিকাংশ সবজি বিক্রেতা বেশি দামে কাঁচা মরিচ কিনতে সাহস পাচ্ছেন না। খুচরা ব্যবসায়ী ইকরাম শেখ বলেন, ‘বেশি দামে মরিচ কিনতে হচ্ছে, তাই বেশি দামে বিক্রি করছি। সব সবজি এবং পেঁয়াজের দামও আকাশ ছোঁয়া। বেনাপোল বন্দর সূত্রে জানা যায় প্রথমদিন ৫০ ট্রাকে ৫৮২ মেট্রিকটন, দ্বিতীয় দিন ১২ ট্রাকে ১৪৪ মেট্রিকটন ও তৃতীয় দিন ৫ ট্রাকে ৮০ মেট্রিকটন কাঁচা মরিচ এসেছে। বন্দর থেকে ছাড়ও পেয়ে গেছে কিন্তু দাম কেন কমছে না-তা বলতে পারবো না-বলেন বন্দরের একাধিক কর্মকর্তা। গত বুধবার বিকাল ৫টা পর্যন্ত উল্লেখিত পরিমাণ আমদানি হয়েছে কাঁচা মরিচের। সূত্রের দাবি-কেনা থেকে শুরু করে শুল্ককর মিলিয়ে আমদানি করা এ মরিচের কেজিপ্রতি খরচ পড়েছে ৯৬-১০০ টাকা। অথচ বেনাপোলসহ যশোরের বাজারে তা বিক্রি হচ্ছে ৩৮০-৪০০ টাকায়। শনিবার (১৯ অক্টোবার) দিনভর যশোর বড়বাজার, তালতলা, স্টেশন ও সাবেক চুয়াডাঙা বাজার ঘুরে দেখা গেছে সব নিত্যপণ্য ঝাঁজ ছড়াচ্ছে। ক্রেতারা বলছেন-কয়েক মাস ধরে কাঁচা মরিচ বাড়তি দামে কিনতে হচ্ছে। ডিম ও ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হচ্ছে চড়া দামে। গরীবের মাছ নামে পরিচিত তেলাপিয়া, পাঙ্গাশ, সিলভার কার্প বিক্রি হচ্ছে রুই কাতলার দামে। যা এখন সাধারণের নাগালের বাইরে। বাজারের হিসাব মিলাতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন নিন্ম ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ। গত ১৫ অক্টোবর পর্যন্ত ৩ দিনে ভারত থেকে ৮০৬ টন কাঁচামরিচ আমদানি করা হয়েছে। তবে, তাতে কোন সুফল মিলছে না, বাড়তি দামেই বিক্রি হচ্ছে কাঁচা মরিচ। সেই ৩৮০ থেকে ৪০০ টাকা কেজিতে কিনতে হচ্ছে। বিভিন্ন সবজির দাম কিছুটা কমে হঠাৎ বৃষ্টি হওয়ায় দাম বেড়ে আকাশ ছুঁয়েছে। বাজারে আগাম সবজির দাম এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে। শিম বিক্রি হচ্ছে ২৮০ টাকা কেজি, ফুলকপি ১৬০, টমেটো ১৮০, বাধাকপি ৮০, গাজর ১৮০, মুলা ৬০ টাকা কেজি। এক আঁটি পালংশাক ৪০ টাকায় কিনতে হচ্ছে। এর বাইরে কাকরোল, ওল, করলা, ঢেড়স ৮০, বেগুন ১৬০, বরবটি ১২০, লাউ ৬০ থেকে ৭০ পিচ, কচুরলতি ১০০, কচুরমুখি ৬০, শসা ৬০ থেকে ৭০ টাকা, ঝিঙে ৭০ থেকে ৮০, ধুন্দল, পটল, মিষ্টি কুমড়া ৬০, কাঁচকলা ৭০, পেঁপে ৪০ টাকা, আলু ৬০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। বিক্রেতা শহিদুল ইসলাম জানান-বাজারে সবজি ও কাঁচা মরিচের সংকট চলছে। কাঁচা মরিচ আমদানি হলেও তা পর্যাপ্ত না। অন্যদিকে, ডিমের দাম কিছুটা কম হলেও তাতে খুব একটা পরিবর্তন আসেনি। ডিম বিক্রি হচ্ছে ৫২ টাকা হালি। সোনালী মুরগির ডিম ৬০ টাকা, দেশি মুরগির ডিম ৬৪ টাকা, হাঁসের ডিম ৭৬ টাকা, কোয়েল পাখির ডিম ১৪ টাকা হালি। ১২টি ডিমের বক্স ১৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আমিষ সাধারণের ধোরাছোঁয়ার বাইরে। স্বস্তার বিভিন্ন মাছও বাড়তি দামে বিক্রি হচ্ছে। বড়বাজারে প্রতি কেজি তেলাপিয়া মাছ বিক্রি হয় ২২০ থেকে ২৫০ টাকা কেজিতে। সিলভার কার্প ২০০ থেকে ২৫০, পাঙ্গাশ ১৫০ থেকে ২০০, কই ১৮০ থেকে ২০০, টাকি ৪০০, শিং ৩২০ থেকে ৪০০, রুই ৩৩০ থেকে ৪০০, কাতলা ৪৫০ থেকে ৫০০, চিংড়ি ৬০০ থেকে ১২০০ টাকা কেজিতে বিক্রি হয়। অন্যদিকে, মাংসের বাজারে ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হচ্ছে ২০০ থেকে ২১০ টাকা কেজি। সোনালী মুরগি ২৮০ টাকা। লেয়ার ৩৫০ টাকা। দেশি মুরগি ৫০০ টাকা। গরুর মাংস ৭০০ টাকা। খাসির মাংস এক হাজার ৫০ টাকা থেকে ১১শ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। শংকরপুরের রিকশা চালক নিজাম, রুপদিয়ার শিক্ষক আব্দুল রইচ ও উপশহরের ঠিকাদার আকমাল হোসেন ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন- মাংস দূরে থাকুক, এখন আর মাছও তেমন কেনা যাচ্ছে না। সরকার বা প্রশাসন কারও এ বিষয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই-অভিযোগ তাদের। মুদি দোকানী গনেশ সাহা বলেন-খোলা সয়াবিন তেল ১৭৫ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। বোতলজাত সয়াবিন তেল ১৬৭ টাকা লিটার। মুগ ডাল ১৬০ থেকে ১৭০ টাকা। মসুরের ডাল ১০৫ থেকে ১৪০ টাকা। ছোলার ডাল ১৩০ থেকে ১৪০ টাকা। বুটের ডাল ৭০ টাকা। খোলা আটা ৪০ টাকা। প্যাকেট আটা ৫০ টাকা। লবণ ৪০ টাকা। চিনি ১৪০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। চালের বাজারে বাড়তি দাম অব্যাহত রয়েছে। সুরুজ মিয়া জানান- স্বর্না চাল ৫২ থেকে ৫৫, আঠাশ ৬৫ থেকে ৬৬ ও কাজললতা ৬৮ টাকা কেজি বিক্রি করতে হচ্ছে। তিনি আরও বলেন-বাংলামতি ও নাজিরশাইল ৮০ থেকে ৯০ টাকা দামে বিক্রি হচ্ছে। জিরা বিক্রি হচ্ছে ৮০০ থেকে এক হাজার টাকা কেজি। এলাচ ৩ হাজার ৫০০ টাকা। লবঙ্গ এক হাজার ৪৫০ থেকে দুই হাজার টাকা। গোলমরিচ এক হাজার টাকা। দারুচিনি ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা কেজি। পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ১০০ থেকে ১২০ টাকা কেজি। রসুন ২০০ থেকে ২৫০ টাকা। আদা ১৬০ থেকে ৩০০ টাকা। এ পরিস্থিতিতে মানুষের সংসার চালাতে নাভিশ্বাস উঠেছে। বেশ কয়েকজন ভোক্তা ক্ষোভ ঝেড়ে বলেন-আমদানি হলেও বাজারে আসছে না। সব ‘শয়তানে খেয়ে ফেলছে’। সচেতন মহল বলছেন-প্রশাসনের তদারিক জোরদার করার দাবি এখন সর্বমহলের। বাজার দর নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। সবকিছুর পেছনে কলকাঠি নাড়ছে সিন্ডিকেট।