যুদ্ধ-সংঘাতের ইতিহাসে শিশুদের জন্য সবচেয়ে খারাপ বছরের একটি ২০২৪
২০২৪ সালে বিশ্বজুড়ে শিশুদের ওপর সশস্ত্র সংঘাতের বিধ্বংসী প্রভাব সম্ভাব্য রেকর্ড পর্যায়ে পৌঁছেছে। চলতি বছরটি যুদ্ধ-সংঘাতে শিশুদের জন্য ইতিহাসের সবচেয়ে খারাপ বছরগুলোর মধ্যে একটি। সর্বশেষ প্রাপ্ত তথ্য এবং বিদ্যমান বৈশ্বিক প্রবণতা পর্যালোচনা করে এ কথা জানিয়েছে জাতিসংঘের বিশেষ সংস্থা ইউনিসেফ।
স্থানীয় সময় শনিবার (২৮ ডিসেম্বর) ইউনিসেফ জানিয়েছে, সংঘাতের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত রেকর্ড সংখ্যক শিশু নিহত ও আহত হয়েছে। এছাড়া অনেক শিশু স্কুলের বাইরে থাকা, জীবন রক্ষাকারী টিকা না পাওয়া এবং গুরুতর অপুষ্টিতে ভুগছে। এই সংখ্যা আরও বাড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। ইউনিসেফের গবেষণায় দেখা গেছে, ফিলিস্তিন থেকে মিয়ানমার, হাইতি থেকে সুদানে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সবচেয়ে বেশি সংঘাতের ঘটনা ঘটেছে বিশ্বে।
বিশ্বের প্রায় ১৯ শতাংশ শিশু (৪৭৩ মিলিয়নেরও বেশি) এখন সংঘাতপূর্ণ অঞ্চলে বসবাস করছে। ৪ কোটি ৭২ লাখ সংঘাত ও সহিংসতার কারণে বাস্তুচ্যুত হয়েছে। গাজায় হাজার হাজার শিশু নিহত ও আহত হয়েছে উল্লেখ করে ইউনিসেফ জানিয়েছে, ইউক্রেনেও জাতিসংঘ ২০২৩ সালের পুরো সময়ের তুলনায় ২০২৪ সালের প্রথম ৯ মাসে বেশি শিশু হতাহতের ঘটনা যাচাই করেছে।
ইউনিসেফ আরও জানিয়েছে, সংঘাতপূর্ণ পরিস্থিতিতে নারীদের বিরুদ্ধে ধর্ষণ এবং যৌন সহিংসতার ব্যাপক খবর পাওয়া গেছে। হাইতিতে চলতি বছর এখন পর্যন্ত শিশুদের বিরুদ্ধে যৌন সহিংসতার রিপোর্ট করা ঘটনাগুলো ১০০০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। সশস্ত্র সংঘাতের পরিস্থিতিতে প্রতিবন্ধী শিশুরাও অসামঞ্জস্যপূর্ণভাবে সহিংসতা এবং অধিকার বঞ্চনার মুখোমুখি হয়।
শিক্ষা কার্যক্রম মারাত্মকভাবে ব্যাহত
সংঘাত কবলিত দেশগুলোর ৫ কোটি ২০ লাখের বেশি শিশু স্কুল বঞ্চিত রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
ফিলিস্তিনের গাজায় সব শিশু এবং সুদানের শিশুদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ এক বছরেরও বেশি সময় ধরে শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। অন্যদিকে ইউক্রেন, গণতান্ত্রিক কঙ্গো প্রজাতন্ত্র এবং সিরিয়ার মতো দেশগুলোতে স্কুলগুলো ক্ষতিগ্রস্তের পাশাপাশি ধ্বংস হয়েছে। যদিও কিছু পুনর্নির্মাণ করা হয়েছে, তবে লক্ষ লক্ষ শিশু শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছে।
শিক্ষার অবকাঠামো ধ্বংস এবং স্কুলের কাছে নিরাপত্তাহীনতা এই অঞ্চলগুলোতে শিশুদের শিক্ষার জন্য ইতিমধ্যে পরিস্থিতির ভয়াবহকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে।
অপুষ্টি ও দুর্ভিক্ষ
সংঘাতপূর্ণ অঞ্চলে শিশুদের মধ্যে অপুষ্টিও উদ্বেগজনক মাত্রায় বেড়েছে। সংঘাত এবং সশস্ত্র সহিংসতা অসংখ্য স্থানে খাদ্যব্যবস্থা ব্যাহত করছে, জনগণকে বাস্তুচ্যুত করছে এবং মানবিক প্রবেশাধিকারকে বাধা দিচ্ছে।
উদাহরণস্বরূপ, সুদানে উত্তর দারফুরে দুর্ভিক্ষ ঘোষণা করা হয়েছিল। ২০২৪ সালে পাঁচটি সংঘাত-প্রভাবিত দেশের পাঁচ লাখেরও বেশি মানুষ সবচেয়ে চরম খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা পরিস্থিতিতে বাস করছে বলে অনুমান করা হচ্ছে।
হুমকির মুখে স্বাস্থ্যসেবা
সংঘাত শিশুদের গুরুত্বপূর্ণ স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার উপরও বিধ্বংসী প্রভাব ফেলছে। টিকা না নেওয়া ও কম টিকা নেওয়া শিশুদের প্রায় ৪০ শতাংশ এমন দেশে বাস করে, যেখানে আংশিক বা পুরোপুরি সংঘাত চলছে। এই শিশুরা প্রায়ই হাম এবং পোলিওর মতো রোগের প্রাদুর্ভাবে পড়ে। সুরক্ষা, পুষ্টি এবং স্বাস্থ্যসেবার প্রবেশের অভাব থাকে।
শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্যের উপরও এর প্রভাব বিশাল। সহিংসতা, ধ্বংস এবং প্রিয়জনদের হারানোর ফলে হতাশা, দুঃস্বপ্ন এবং ঘুমাতে অসুবিধা, আক্রমণাত্মক আচরণ, দুঃখ এবং ভয়ের মতো প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে।
ইউনিসেফের নির্বাহী পরিচালক ক্যাথরিন রাসেল বলেন, প্রায় সব পরিমাপকেই দেখা যায়, ২০২৪ সাল ইউনিসেফের ইতিহাসে শিশুদের জন্য রেকর্ড করা সবচেয়ে খারাপ বছরগুলোর একটি। ক্ষতিগ্রস্ত শিশুর সংখ্যা এবং তাদের জীবনে এসবের প্রভাবের মাত্রা – উভয় দিক থেকেই বছরগুলোর একটি এটি। আমরা শিশুদের একটি প্রজন্মকে ‘বিশ্বের অনিয়ন্ত্রিত যুদ্ধের সমান্তরাল ক্ষতিতে’ পরিণত হতে দিতে পারি না।