রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র: জ্বালানি সংকটে আটকা বাণিজ্যিক উৎপাদন

Share Now..


গ্রিডে সংযুক্ত এবং পরীক্ষামূলক উৎপাদন শুরু করেও পূর্ণ উদ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু করতে পারছে না রামপাল কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র। ডলারের সংকটের কারণে ঋণপত্র (এলসি) খুলতে জটিলতা ও বিলম্ব হওয়ায় প্রয়োজনীয় পরিমাণে আমদানি করা যাচ্ছে না কেন্দ্রটির জ্বালানি কয়লা। স্বল্প মেয়াদে কয়লা আনা হলেও দীর্ঘমেয়াদি আমদানি চুক্তি স্বাক্ষরের কাজ এখনো সম্পন্ন করতে পারেনি কেন্দ্রটির পরিচালন কোম্পানি বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী বিদ্যুৎ কোম্পানি (বিআইএফপিসিএল)। এর ফলে গ্রিড সংযুক্তি (সিনক্রোনাইজেশন) এবং পূর্ণ ক্ষমতায় ৭২ ঘণ্টা পরীক্ষামূলক উৎপাদন সম্পন্নের পরও বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু করা যাচ্ছে না সরকারের ফাস্ট ট্র্যাকভুক্ত বিদ্যুৎকেন্দ্রটিতে।

সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশের উত্তর-পশ্চিম প্রান্তসীমা থেকে ১৪ কিলোমিটার দূরে ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতার কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে বিআইএফপিসিএল। বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ উদ্যোগে নির্মাণাধীন কেন্দ্রটির প্রতি ইউনিটের উৎপাদন ক্ষমতা ৬৬০ মেগাওয়াট। মৈত্রী সুপার থার্মাল বিদ্যুৎকেন্দ্রে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) এবং ভারতের ন্যাশনাল থার্মাল পাওয়ার করপোরেশনের (এনটিপিসি) সমান মালিকানা রয়েছে। কেন্দ্রটি পরিচালনা করছে সমান ৫০ শতাংশ অংশীদারিত্বে গঠিত বিআইএফপিসিএল। এর নির্মাণ ঠিকাদার হিসেবে কাজ করছে ভারত হেভি ইলেকট্রিক্যালস লিমিটেড (ভেল)। ১৬ হাজার কোটি টাকার প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ১২ হাজার ৮০০ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে ভারতের এক্সিম ব্যাংক। প্রকল্প বাজেটের ৮২ দশমিক ৬৬ শতাংশ, অর্থাৎ ১৩ হাজার ২২৬ কোটি টাকা ইতিমধ্যে খরচ হয়ে গেছে।

বিআইএফপিসিএল সূত্র জানায়, গত ১৫ আগস্ট রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রথম ইউনিট (৬৬০ মেগাওয়াট) জাতীয় গ্রিডের সঙ্গে সংযুক্ত হয়। ঐ দিনে গ্রিডে ৯১ দশমিক ৭ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ করে বাংলাদেশ-ভারত যৌথ উদ্যোগে নির্মিত কেন্দ্রটি। তবে বেশি দিন বিদ্যুৎ উৎপাদন রাখা যায়নি। গত ২৪ অক্টোবরে ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের আঘাত থেকে ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে উৎপাদন বন্ধ রাখা হয়। প্রায় এক মাস শেষে গত ২৪ নভেম্বর পুনরায় পরীক্ষামূলক উৎপাদন শুরু হয়। ন্যাশনাল লোড ডেসপাস সেন্টার (এনএলডিসি) রিলায়েবিলিটি রান টেস্টের অনুমোদন দেয় ১১ ডিসেম্বরে। ১৭ ডিসেম্বর এতে পূর্ণ সক্ষমতায়, অর্থাৎ ৬৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রথম উৎপাদিত হয়। কেন্দ্রটি পূর্ণ সক্ষমতায় উৎপাদন করতে পারবে কি না, তা যাচাইয়ের জন্য টানা ৭২ ঘণ্টা ফুল লোডে চালু রেখে যাচাই করার শর্ত ছিল। ১৯ ডিসেম্বর রাত ১২টা থেকে ২৩ ডিসেম্বর রাত ৪টা পর্যন্ত পূর্ণ সক্ষমতায় টানা ৯০ ঘণ্টা বিদ্যুৎ উৎপাদন করে কেন্দ্রটি এর কারিগরি সক্ষমতারও প্রমাণ দেয়।

রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রে ৫০০০ ক্যালরিফিক মানের কয়লা দরকার হয়, যা ইন্দোনেশিয়া, অস্ট্রেলিয়া বা দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে আমদানি করার শর্ত রয়েছে। প্রতি ইউনিট পূর্ণ সক্ষমতায় পরিচালনার জন্য দৈনিক ৪ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন কয়লা দরকার। অর্থাৎ, দুই ইউনিট পূর্ণ উদ্যমে চালু হলে দৈনিক ৯ হাজার টন কয়লা লাগবে। কিন্তু এলসি জটিলতায় কয়লা আমদানি ব্যাহত হওয়ায় গত ১৪ জানুয়ারি সকাল ৯টার দিকে বিদ্যুৎকেন্দ্রটির উৎপাদন ফের বন্ধ হয়ে যায়। কেন্দ্রটিতে কয়লা মজুতের সক্ষমতা রয়েছে তিন মাসের। নিয়ম অনুযায়ী এক মাসের কয়লা মজুত রাখার বাধ্যবাধকতা থাকলেও উৎপাদন বন্ধ হওয়ার আগে কেন্দ্রটিতে কয়লার কোনো মজুত ছিল না। এরপর গত ৯ ফেব্রুয়ারি একটি জাহাজ ৩০ হাজার মেট্রিক টন কয়লা নিয়ে বিদ্যুৎকেন্দ্রের জেটিতে ভেড়ে। গত বুধবার দিবাগত রাতে কেন্দ্রটিতে ফের উৎপাদন শুরু হয়েছে। তবে প্রয়োজনীয় কয়লা আমদানি অব্যাহত না থাকলে ফের উৎপাদন বন্ধ হয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্টরা।

একটি বিদ্যুৎকেন্দ্রে পরীক্ষামূলক উৎপাদন পর্যায় সম্পন্ন হলে বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু হয়। বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরুর একটি তারিখ (কমার্শিয়াল অপারেশন ডেট-সিওডি) নির্ধারণ করে দেয় বিদ্যুতের পাইকারি ক্রেতা বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। কিন্তু সিওডি বা বাণিজ্যিক উৎপাদন এখনো শুরু হয়নি। ডলার ও জ্বালানিসংকটের কারণে অনিশ্চয়তা তৈরি হওয়ায় এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে বলে জানিয়েছেন পিডিবির এক শীর্ষ কর্মকর্তা।

গ্রিড সংযুক্তি ও পরীক্ষামূলক উৎপাদন শুরুর পর গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ইউনিটটিতে ৪৯ কোটি ১০ লাখ ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে। গত ৯ থেকে ২৯ ডিসেম্বর টানা চালু ছিল কেন্দ্রটি। এর আগে বাংলাদেশে সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তির কোনো কেন্দ্র সিওডির আগে এত দীর্ঘ সময় টানা চালু থাকেনি।

রামপাল কেন্দ্রের প্রকল্প পরিচালক সুভাস চন্দ্র পান্ডে বলেন, ‘ডলারের সংকটে এলসি খোলা যায়নি, যার কারণে কয়লার অভাবে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি বন্ধ রাখতে হয়। এখন কয়লার সরবরাহ কিছুটা স্বাভাবিক হওয়ায় পুনরায় কেন্দ্রটি চালু করা হয়েছে। আশা করছি এলসি জটিলতা না থাকলে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে দ্বিতীয় ইউনিট থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু করতে পারব। সেটি সেপ্টেম্বরে চালু হওয়ার কথা রয়েছে।’ তিনি বলেন, এখন পাইপলাইনে যে কয়লা রয়েছে, তা দিয়ে কেন্দ্রটির একটি ইউনিট আগামী এপ্রিল পর্যন্ত চালানো সম্ভব। তবে এর জন্য এলসি জটিলতা দূর করতে হবে।

কেন্দ্রটিতে উৎপাদিত বিদ্যুতের দাম সম্পর্কে তিনি বলেন, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রকল্প পরিচালক সুভাস চন্দ্র পান্ডে বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে কয়লার দাম বেড়ে যাওয়ায় বর্তমানে বিদ্যুৎ উৎপাদনে খরচ পড়ছে প্রতি ইউনিট ১৩-১৪ টাকা। বিশ্ববাজারে কয়লার দাম কমে এলে উৎপাদন খরচও কমে আসবে।

বিআইএফপিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী সাঈদ আকরাম উল্লাহ বলেন, কয়লার দীর্ঘমেয়াদি জোগানের জন্য দরপত্র মূল্যায়ন সম্পন্ন হয়েছে। বাকি আনুষ্ঠানিকতা শেষে যত দ্রুত সম্ভব এটি সম্পন্ন করা হবে। আর আগামী দুই-তিন দিনের মধ্যে কয়লার আরেকটি কার্গো জেটিতে আসবে। পরিকল্পনা অনুযায়ী কার্গোগুলো আনা গেলে সমস্যা তৈরি হবে না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *