১৬ মাস বয়সের বাচ্চা দেখেও কারো মন গলেনি!

Share Now..

ঘড়ির কাঁটা সকাল ১০টা পেরিয়েছে। একটু পরই পঞ্চগড়ের উদ্দেশে যাত্রা করবে পঞ্চগড় এক্সপ্রেস ট্রেন। কমলাপুর রেলস্টেশনের ৭ নম্বর প্লাটফর্মে দাঁড়াতেই আগে থেকে অপেক্ষায় থাকা মানুষজন হুমড়ি খেয়ে পড়ল। এ যেন কোনো যুদ্ধ। এ যুদ্ধ আগে আগে ট্রেনে উঠে জায়গা নিশ্চিত করা। নইলে অন্য কারো দখলে চলে যেতে পারে নির্ধারিত আসন। যে কারণে শত কষ্ট, ভোগান্তি আর ঝুঁকি নিয়ে হলেও ট্রেনে উঠতেই হবে।

এদিকে ট্রেনে ওঠার অসম প্রতিযোগিতায় এক পর্যায়ে ধাক্কাধাক্কি লেগে গেল। আধঘণ্টার মধ্যে ট্রেনের ভেতর থেকে শুরু করে ছাদ পর্যন্ত মানুষে পূর্ণ হয়ে যায়। পরে অবশ্য দায়িত্বরত কর্মকর্তা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা অধিকাংশ যাত্রীকেই ট্রেনের ছাদ থেকে নামিয়েছেন। তবে এ কাজ করতে গিয়ে রেলওয়ে পুলিশকে বেশ বেগ পেতে হয়। কেউই নামতে চায় না ছাদ থেকে। যাত্রীদের ছাদ থেকে নামাতে সেখানে পানি ঢেলে দিতে দেখা যায়। অনেককে লাঠি দিয়ে পেটানোর ভঙ্গি করে ভয় দেখিয়েও ট্রেনের ছাদ থেকে নামাতে দেখা যায় রেলওয়ে পুলিশকে। কিন্তু তারপরও কিছু লোকজন থেকেই যায়।

কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে রেলওয়ে পুলিশের দায়িত্বরত এক কর্মকর্তা বলেন, আমরা চেষ্টা করছি যাত্রীদের ছাদ থেকে নিচে নামাতে। কিন্তু তারা কিছুতেই নামতে চায় না। যারা মনে করে যে ভেতরে চাপাচাপিতে গরম লাগবে, তারাই ছাদে যায়। কিন্তু এভাবে ভ্রমণ তো ঝুঁকিপূর্ণ। তাই তাদের ছাদ থেকে নামাতে সব ধরনের চেষ্টাই অব্যাহত আছে।

বউ-বাচ্চা নিয়ে রীতিমতো যুদ্ধ করেই ট্রেনে উঠলেন এলিট ফোর্স সিকিউরিটি সার্ভিসের ইনচার্জ মেহেদী মামুন। তিনি যাবেন পঞ্চগড়। তার স্ত্রীর কোলে ১৬ মাস বয়সের বাচ্চা দেখেও কারো মন গলেনি এতটুকুও। ট্রেনের জায়গা দখলে কেউ একবিন্দু ছাড় দিতে রাজি নয়। তাদের ধাক্কাধাক্কি দেখে ভয়ে কিছুই বুঝতে না পারা বাচ্চাটি কেঁদে নিজের অসহায়ত্ব প্রকাশ করল। এর কিছুক্ষণ পর এক ধরনের যুদ্ধ শেষে ট্রেনে উঠতে পারলেন মেহেদী মামুন।

তিনি বলেন, এটা কি কোনো পরিবেশ হলো! ট্রেনে শৃঙ্খলার কোনো বালাই-ই নেই। কর্তৃপক্ষ টিকিট কেটে লোক ঢোকালে এই অবস্থা হতো না। জানি না কখন বাড়ি যেতে পারব।

তিনি আরও বলেন, ৭ তারিখ টিকিট কেটেছি। ৮ তারিখ রাত ১০টা ৪৫ মিনিটে আমাদের ট্রেন ছাড়ার কথা ছিল। কয়েকবার শিডিউল বিপর্যয়ের পর আজ সকালে ট্রেন এল। কিন্তু ট্রেন এলেও আমি উঠতে পারছিলাম না। কি যে অবস্থা! আমার পরিবার সঙ্গে। বাচ্চাও রয়েছে। পরে ধাক্কাধাক্কি করে উঠতে হয়েছে। যারা টিকিট কাটেনি, তারাই আগে ট্রেনে উঠে বসে আছে, তারাই বিশৃঙ্খলা করেছে।

পাশ থেকে ভিড় ঠেলে তার সঙ্গে ১৬ মাস বয়সের বাচ্চা কোলে তার স্ত্রী এসে বলেন, আমাকে বলা হলো, বাচ্চা নিয়ে কেন এসেছি! এই বাচ্চা আমি কোথায় রেখে আসব! আমাকে তো ঢুকতেই দেওয়া হচ্ছিল না। ধাক্কা দিয়ে বের করে দিচ্ছিল।

গার্মেন্টস শ্রমিক রশীদ যাবেন দিনাজপুর। তিনি বলেন, বাসে যেতে দুদিন লাগবে। তাই ট্রেনে যাওয়া। কষ্ট হলেও কি করব, বাড়ি তো যেতেই হবে। পরিবারের সঙ্গে ঈদের আনন্দ তো ঢাকায় পাওয়া যাবে না।

ফকির ফ্যাশনের চাকরি করেন হারুনুর রশীদ। গতকাল রাত ৮টা থেকে তিনি স্টেশনে ট্রেনের অপেক্ষায় ছিলেন। হারুনুর রশীদ বলেন, দুই দিন ধরে লাইনে দাঁড়িয়ে টিকিট কেটেছি। গতকাল রাত পৌনে ১১টায় গাড়ি ছাড়ার কথা। কিন্তু গাড়ি এল না। সময় পরিবর্তন করে রাত ৩টায় ট্রেন ছাড়ার কথা ছিল। এরপর তিনটায় শিডিউল পরিবর্তন করে ভোর ৫টা, ভোর ৫টায় শিডিউল পরিবর্তন করে সকাল ৯টা, সকাল ৯টায় শিডিউল পরিবর্তন করে সকাল ১০টা ১৫ মিনিটে টাইম দেওয়া হয়েছে। দুই দিন লাইনে দাঁড়িয়ে কষ্ট করে টিকিট কাটার পরও ঠিক সময়ে ট্রেন ছাড়তে পারেনি। গতকাল রাত থেকে নির্ঘুম, এরই মধ্যে অসুস্থ বোধ করছি। কখন বাড়ি যেতে পারব জানি না। বাড়ি গিয়ে ঈদ করতে পারব কিনা সেটাও অনিশ্চিত। তারা যদি ঠিকমতো শিডিউল পর্যবেক্ষণ করে, তাহলে এই বিপর্যয় ঘটত না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *