যশোরের গদখালিতে ফুল উৎপাদনে ব্যস্ত ফুলচাষীরা, ঘুরে দাঁড়ানোর মুখে নতুন শঙ্কা ওমিক্রন
এস আর নিরব যশোরঃ
যশোরের গদখালিতে ফুল উৎপাদনে ব্যস্ত সময় পার করছেন ফুলচাষীরা । ফুলের সাম্রাজ্য গদখালি এলাকায় এখন ফুলে ফুলে পরিপূর্ণ।মহামারী করোনা ও আম্পান ঘূর্ণিঝড়ের কারণে টানা দুই বছরের মন্দাভাব কাটিয়ে উঠতে গত কয়েক মাস ধরে পরিশ্রম করছেন যশোরের গদখালির ফুলচাষি শফিকুল ইসলাম (৬০)। মাস চারেক পরিচর্যায় বর্তমানে দেড় বিঘা জমিতে গোলাপ, ১২ কাঠা জমিতে জারবেরা ও দেড় বিঘা জমিতে গাঁদাফুলে ফুলে ভরে গেছে তার। আসছে পয়লা ফাল্গুন, বিশ্ব ভালোবাসা দিবস, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ও মহান শহীদ দিবস এবং স্বাধীনতা দিবসের আগ মুহূর্ত পর্যন্ত ফুলগুলো বিক্রি করে গত দুই বছরের ক্ষতি পুষিয়ে নিবেন তিনি। কিন্তু ঘুরে দাঁড়ানোর মুখে হঠাৎ করোনার নতুন ভেরিয়েন্ট ওমিক্রন চিন্তার ভাঁজ ফেলেছে তার। করোনার বিধিনিষেধে ইতোমধ্যে সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রোগ্রাম বন্ধ হওয়ায় কমতে শুরু করেছে ফুলের দাম। এমন পরিস্থিতিতে সামনের দিবসগুলোতে ফুল বিক্রি নিয়ে সংশয়ে রয়েছেন ২০ বছর ধরে ফুল চাষ করা শরিফুল।
ফুলচাষি শরিফুল ইসলামের বাড়ি গদখালি অঞ্চলের নীলকণ্ঠ গ্রামে। তিনি বলেন, করোনা আর আম্পানে লন্ডভন্ড হওয়া ফুলক্ষেত ব্যাংক ও এনজিও থেকে ৮ লাখ টাকার ঋণ নিয়ে পরিচর্যা শুরু করেছিলাম। গেল নভেম্বর থেকে ফুল বেচাকেনা শুরু করেছি। ১৪ ও ১৬ ডিসেম্বর দুই দিবসে ভালো দামে প্রায় ২ লাখ টাকার ফুল বিক্রি করেছি। আশা করেছিলাম, সামনের দিবসে সঠিক দামে ফুলগুলো বিক্রি করতে পারলে ৮ লাখ টাকার ঋণ শোধ করতে পারবো। কিন্তু জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহ থেকে করোনার সাথে এসেছে নতুন ভেরিয়েন্ট ওমিক্রন। ফুলের ভরা মৌসুমে সরকার সকল অনুষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়ায়; ফুলের দাম কমে গেছে। কোন কারণে যদি আবার ফুল বেচাকেনায় ভাটা পড়ে তাহলে তার পথে বসা ছাড়া গতি থাকবে না।
যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার গদখালি-পানিসারা ইউনিয়ন। এই দুই ইউনিয়নসহ আশপাশের এলাকায় প্রায় এক হাজার একর জমিতে উৎপাদন হচ্ছে দেশি-বিদেশি নানা জাতের ফুল। যেদিকে চোখ যায় শুধু ফুল আর ফুল। ফুলে ফুলে রঙিন হয়ে আছে মাঠগুলো। পথের দুই ধারে গোলাপ, রজনীগন্ধা, গ্ল্যাডিওলাস, গাঁদা, জারবেরা ফুলের ক্ষেত। লাল, নীল, হলুদ, বেগুনি আর সাদা রঙের এক বিস্তীর্ণ বিছানা যেন বিছিয়ে রেখেছে। এ দৃশ্যে চোখ জুড়ানোর পাশাপাশি জুড়িয়ে যায় হৃদয়ও। দেশে উৎপাদিত ফুলের ৭০ ভাগ যোগান হয় এখান থেকে। যেখানে গেলে চোখে পড়বে কৃষকদের ব্যস্ততা। কেউ ফুল কেটে বাজারে নিয়ে যাচ্ছে, সেখান থেকেই বান্ডিল করে চালান হয়ে যাচ্ছে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন শহরে। কেউ ফুল কাটছে, কেউ নিড়ানি দিচ্ছে। ফুলের ভরা মৌসুমের এমন কর্মব্যস্ততায় মুখে চওড়া হাসি থাকার কথা থাকলেও; করোনা-ওমিক্রনে চিন্তার ভাঁজ এখানকার ফুল চাষিদের কপালে।
পানিসারা এলাকার ফুল চাষি ইসমাইল জানান, গেল দুই বছর লকডাউনের কারণে ফুল বেঁচতে না পেরে নিঃস্ব হতে বসেছিলাম। কেউ আবার ফুলের আবাদ ছেড়ে অন্য ফসলের আবাদ শুরু করেছে। করোনার প্রকোপ কিছুটা কমায় সেপ্টেম্বর থেকে ঘুরে দাঁড়াতে ঋণ নিয়ে নতুন করে শুরু করেছিলাম ফুলের আবাদ। কিন্তু ৪ মাস ফুল পরিচর্যা করে ফুলের ভরা মৌসুমে এসে নতুন ভেরিয়েন্ট ওমিক্রনে সামনের দিবসগুলোতে ফুল বেচাকেনায় সংশয়ে রয়েছি। পানিসারার হাড়িয়াদাড়া এলাকার ফুল চাষি সাঈদ আলী জানান, ২০ হাজার টাকা খরচ করে দেড় বিঘা জমিতে গাঁদাফুল চাষ করেছি। ডিসেম্বর পর্যন্ত ভালো দাম ছিলো, তবে জানুয়ারি থেকে করোনা বাড়ায় অনুষ্ঠান বন্ধ হচ্ছে। সেইসাথে আমাদের ফুল বেচাকেনায় দামে ধস নেমেছে।
গদখালির টাওরা গ্রামের কৃষক নিজাম উদ্দিন বলেন, করোনার কারণে গত বছর বিশ্ব ভালোবাসা দিবস ও পয়লা ফাল্গুনে কোন উৎসব না হওয়ায় ফুল বিক্রি করতে পারেনি। তবে গেল বছরের সেপ্টেম্বর থেকে করোনা স্বাভাবিক হওয়ায় ডিসেম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন অনুষ্ঠান হওয়ায় ফুল বেচাকেনা ছিলো ভালো। এবারও ভালোবাসা দিবস ও পয়লা ফাল্গুনে আসন্ন সময়ে করোনার হানা দিয়েছে। তাই এ বছরও কত টাকার ফুল বিক্রি হবে, তা নিয়ে অবশ্য শঙ্কায় আছেন তিনি। কারণ, চলমান করোনা পরিস্থিতিতে দেশে সামাজিক আচার-অনুষ্ঠান ব্যাপক হারে কমেছে। উৎসব আয়োজনও সীমিত হয়ে পড়েছে। অন্য অনেক ফুলচাষিও অতীতের মতো ফুল বিক্রি হওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছেন।
গদখালি বাজারে কৃষক ও স্থানীয় পাইকার ব্যবসায়ী ইসমাঈল হোসেন বলেন, বর্তমানে ফুলের বাজার খারাপ। লকডাউন না দিলেও করোনা আতঙ্কে ফুল বেচাকেনা কম। বর্তমানে বাজারে প্রতি হাজার গাঁদাফুল বিক্রি হচ্ছে ২০০ টাকা। যা সপ্তাহ খানেক আগে ছিলো ৮০০ থেকে ৯০০ টাকা দরে। একেকটি গোলাপ বিক্রি হচ্ছে ২ টাকা, যা আগে বিক্রি হয়েছে ৪-৬ টাকায়। রজনীগন্ধা একেকটির স্টিক বিক্রি হচ্ছে সাড়ে ৫ থেকে ৬ টাকায়, যা আগে ছিল ৭-১০ টাকা। রঙিন গ্লাডিউলাস প্রতিটি মানভেদে বিক্রি হচ্ছে ৬-৯ টাকায়, যা আগে ছিল ৯-১৫ টাকা। জারবেরা বিক্রি হচ্ছে ৬- ৮টাকায়, যা আগে দাম ছিল ৮-১৫ টাকা। ফুলবাঁধার জন্য কামিনীর পাতা বিক্রি হচ্ছে ৩০-৪০ টাকা আঁটি, যা আগে ছিল ৫০-৬০ টাকা। জিপসির আঁটি বিক্রি হচ্ছে ২০-৩০ টাকা। যা আগে বিক্রি হতো ৩০-৪৫ টাকায়।
এদিকে ওমিক্রনের কারণে যাতে লকডাউনের কবলে পড়তে না হয় তার জন্য কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য সরকারের প্রতি দাবি জানিয়েছেন ফুল চাষিদের নেতারা। বাংলাদেশ ফ্লাওয়ার্স সোসাইটির সভাপতি আব্দুর রহিম বলেন, ফুলের ব্যবসাটি মূলত অনুষ্ঠানকেন্দ্রিক। গত দুই বছর লকডাউনের কারণে ফুল বিক্রি করতে না পেরে নিঃস্ব হতে বসেছিল চাষিরা। কেউ আবার ফুলের আবাদ ছেড়ে অন্য ফসলের আবাদ শুরু করেছিলেন। করোনার প্রকোপ কিছুটা কমায় ঘুরে দাঁড়াতে ঋণ নিয়ে নতুন করে শুরু করে ফুলের আবাদ। কিন্তু ঘুরে দাঁড়ানোর মুখে নতুন ভেরিয়েন্ট ওমিক্রন চিন্তার ভাঁজ ফেলেছে তাদের কপালে। লকডাউন দিয়ে দিলে কার্যত ফুলের বাজার বলে আর কিছু থাকে না। আমরা আশা করব সরকার আমাদের দিকে দৃষ্টিপাত করবে।
যশোর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক বাদল চন্দ্র বিশ্বাস বলেন, চলতি বছর ঝিকরগাছার গদখালি-পানিসারা এলাকায় সাড়ে ৬শ’ হেক্টর জমিতে বিভিন্ন জাতের ফুল চাষ হয়েছে। করোনাকাল কাটিয়ে উঠে এখানকার কৃষকরা অনেকটাই ঘুরে দাঁড়িয়েছিলো। এবার ফুলের উৎপাদন, চাহিদা ও দাম সবই বেশ ভালো ছিলো। পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলে ক্ষতি পুষিয়ে লাভবান হবেন ফুল চাষিরা।