‘বঙ্গবন্ধুর ভাষণের দুটি শব্দে অনুপ্রাণিত হয়ে যুদ্ধে যাই’
২৩ মার্চ চট্টগ্রামে নৌবাহিনীর বাঙালি সদস্যদের নিরস্ত্র করে সবাইকে ব্যারাকে অবস্থান করতে নির্দেশ দেওয়া হলো। বুঝতে বাকি রইল না, কী ঘটতে যাচ্ছে। ২৬ মার্চ রাতের আঁধারে ব্যারাকের কাঁটাতারের বেড়া ডিঙিয়ে পালালাম। পরদিন সকালে স্থানীয় আওয়ামী লীগ অফিসে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নিজের নাম তালিকায় তুললাম। নিজের খাকি উর্দি ছেড়ে গামছা গায়ে লুঙ্গি পরে নিলাম ছদ্মবেশ। স্থায়ী চাকরি ছেড়ে শুরু হলো যুদ্ধজীবন।’ ইত্তেফাকের কাছে মুক্তিযুদ্ধের সময় নিজের যুদ্ধে যাওয়ার গল্প বলতে গিয়ে এভাবেই বলছিলেন লে. কমান্ডার (অব.) মোহাম্মদ জালাল উদ্দীন বীর-উত্তম।
যুদ্ধের সময় ৩৫ বছরের তাগড়া জোয়ান মানুষটির বয়স এখন ৮৬ বছর। তবু মনে হলো চোখের কোণে তার সোনালি দিনের স্মৃতি। নৌ-কমান্ডো বীর-উত্তম জালাল উদ্দীন বলেন, যখন যুদ্ধ শুরু হলো, তখন তিনি ছিলেন পিএনএস বখতিয়ারে একজন লিডিং সি ম্যান বা নাবিক। এই পিএনএস বখতিয়ার ছিল পাকিস্তান নৌবাহিনীর পূর্বাঞ্চলের সবচেয়ে বড় ঘাঁটি।
এর কিছুদিন আগে পাকিস্তানের করাচি থেকে বদলি হয়ে চট্টগ্রামের বখতিয়ার ঘাঁটিতে আসেন জালাল উদ্দীন। ৭ মার্চের ভাষণ শোনার পর থেকে তার মনে পরিবর্তন শুরু হলো। তিনি বলেন, ‘৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু যখন বললেন, এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম—মুক্তি ও স্বাধীনতা—এই দুই শব্দই আমাকে অনুপ্রাণিত করল স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য যুদ্ধ করতে।’
বখতিয়ার ঘাঁটি থেকে পালিয়ে যাওয়ার পর ২৭ মার্চ ভোরে তিনি গেলেন চট্টগ্রামের হালিশহরে এম এ আজিজ এবং এম এ মজিদের বাড়িতে। যেখানে সুবেদ আলী ভূঁইয়াসহ আরো অনেক মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। এরপর ২৯ মার্চ তাদের ১২০ জনকে নিয়ে একটি মুক্তিযোদ্ধার দল গঠন করা হলো। কিন্তু বিধি বাম! ৩০ মার্চ পাকিস্তান বাহিনী অ্যামবুশ করে তাদের ওপর! তার সঙ্গে থাকা ১৫-১৬ জন শহিদ হলেন। সবাই ভড়কে গেলেন। যে যার মতো গা ঢাকা দিলেন। পরদিন সকালে জালাল উদ্দীন চলে গেলেন তার পরিবারের কাছে। চট্টগ্রামের বখতিয়ার ঘাঁটিতে ছিলেন তার স্ত্রী শিরিন, পুত্র বিলালউদ্দীন, কন্যা নার্গিস এবং ভাগনি সিয়ারুন। তাদের সঙ্গে নিয়ে হাঁটা দিলেন গ্রামের বাড়ি মাগুরার উদ্দেশে। প্রায় পাঁচ দিন হেঁটে, কিছু ছোট ছোট যানবাহনে তারা গ্রামের বাড়ি পৌঁছালেন। এই স্মৃতি বলতে গিয়ে জালাল উদ্দীন বললেন, ‘আমার স্ত্রীর সহযোগিতা না পেলে মুক্তিযুদ্ধ করা হতো না। সে সময় দেশের সবার মতো আমার স্ত্রীও অনেক কষ্ট করেছেন। সন্তানদের নিয়ে অনেক কষ্টে দিন পার করেছেন। আমি মনে করি, আমার স্ত্রীও একজন মুক্তিযোদ্ধা।’
গ্রামের বাড়িতে ফিরেও থাকা হলো না জালাল উদ্দীনের। তাকে খুঁজতে স্থানীয় মোহাম্মদপুর থানার ওসি এলেন বাড়িতে। সেই স্মৃতি মনে করে তিনি বলছেন, ‘১৫ এপ্রিল মোহাম্মদপুর থানার ওসি এসে বললেন, হয় আমাদের সঙ্গে থানায় চলেন, না হলে বাড়ি ছাড়েন। এরপর ১৬ জন মুক্তিযোদ্ধাকে সঙ্গে নিয়ে ২৫ এপ্রিল ভারতে যাওয়ার উদ্দেশে রওনা দিলাম। তিন দিন পর পৌঁছালাম রানাঘাট।’ এই খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা বলছিলেন, ‘এরপর ২৮ এপ্রিল এম এ জি ওসমানী এলেন ক্যাম্পে। তিনি বললেন—তুমি ৯ নম্বর সেক্টরে মেজর জলিলের ওখানে যাও। ওসমানীর স্বাক্ষর করা চিঠি নিয়ে গেলাম ৯ নম্বর সেক্টরে। সেখানে থাকলাম ১২ মে পর্যন্ত। পরবর্তী সময়ে আমরা ৩৫০ জনের মতো প্রশিক্ষণ নিলাম পলাশীতে। সেখানে আমাদের দলের এই প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চলল আগস্ট মাস পর্যন্ত।
‘দিনগুলো যতটা সহজ মনে হচ্ছে, ততটা সহজ ছিল না। পরনের জামার সংকট, খালি পা, আধপেটা খাবারের মধ্যে বুকভরা মনোবলই শুধু ছিল তখন মুক্তিযোদ্ধাদের একমাত্র সম্বল। তেমনি মনোবল নিয়ে পলাশীতে প্রশিক্ষণ নেওয়াদের মধ্য থেকে ১৪ জনের একটি দল নিয়ে ছয় দাঁড়ের একটি নৌকায় করে হাসনাবাদ হয়ে সুন্দরবন পৌঁছালাম আমরা। আমাদের সঙ্গে ছিল চারটি এসএমজি, ১৪টি লিম্পেট মাইন আর এসএলআর-এর ২০ হাজারের মতো গুলি।’