খোলা সয়াবিনের কৃত্রিম সংকট
তেল নিয়ে তেলেসমাতি কারবার শুরু হয়েছে। হঠাত করেই রাজধানীর কোনো কোনো বাজার থেকে খোলা সয়াবিন তেল উধাও হয়ে গেছে। আর বোতলজাত সয়াবিন তেল পাওয়া গেলেও তা সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে অনেক বেশিতে বিক্রি হচ্ছে। গতকাল শুক্রবার রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে খোঁজ নিয়ে এ অবস্থা দেখা যায়। সরকারের বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশও (টিসিবি) গতকাল তাদের নিত্যপণ্যের বাজারদরের প্রতিবেদনে বাজারে খোলা সয়াবিন তেল না পাওয়ার বিষয়টি জানিয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, গত বুধবার বাণিজ্যমন্ত্রী নতুন করে সয়াবিন তেলের দাম বাড়ানোর ব্যবসায়ীদের প্রস্তাব নাকচ করার পরই একশ্রেণির ব্যবসায়ী ভোজ্যতেলের বাজারে এ অস্থিরতা সৃষ্টি করেছে। এর আগে গত ২৭ ফেব্রুয়ারি ভোজ্যতেল বিপণনকারী কোম্পানিগুলোর সংগঠন বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার অ্যাসোসিয়েশন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়ে সয়াবিন তেলের দাম লিটারে আরো ১২ টাকা বাড়ানোর প্রস্তাব করে। তাদের প্রস্তাবে ১ লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেলের নতুন দাম ১৮০ টাকা নির্ধারণের কথা বলা হয়েছে। আর ৫ লিটার সয়াবিন তেলের দাম ৮৭০ টাকা করার কথা বলা হয়েছে। নতুন প্রস্তাবে খোলা সয়াবিন ও পামঅয়েলের দামও বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে।
নতুন এই দর ১ মার্চ থেকে কার্যকর হবে বলে প্রস্তাবে বলা হয়। কিন্তু গত ২ মার্চ সচিবালয়ে নিত্যপণ্যের মজুত ও সরবরাহ পরিস্থিতি নিয়ে আয়োজিত এক আন্তঃমন্ত্রণালয়ের বৈঠক শেষে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি সাংবাদিকদের বলেন, ‘বিপণনকারী কোম্পানিগুলো সয়াবিন তেলের দাম আরো ১২ টাকা বাড়ানোর প্রস্তাব করেছিল। কিন্তু আমরা বলেছি, সামনে রমজান মাস। তাই এখন সয়াবিন তেলের দাম বাড়ানো যাবে না’। কিন্তু বাণিজ্যমন্ত্রীর দাম না বাড়ানোর এ নির্দেশের পর ঐদিন বিকালেই সয়াবিন ও পামঅয়েলের দাম আরেক দফা বেড়েছে। এর আগে সর্বশেষ ৬ ফেব্রুয়ারি সরকারিভাবেই সয়াবিন তেলের দাম লিটারে আট টাকা বাড়ানো হয়েছিল।
সংশ্লিষ্টরা আরো জানিয়েছেন, যেহেতু আগামী ৩১ মের পর থকে সয়াবিন এবং ৩১ ডিসেম্বর থেকে পামঅয়েল খোলা অবস্থায় বিক্রি করা যাবে না। প্যাকেটজাত করে বিক্রি করতে হবে। তাই অসাধু ব্যবসায়ীদের একটি চক্র অধিক মুনাফার আশায় আগেভাগেই বাজার থেকে খোলা সয়াবিন তেল সরিয়ে ফেলছে। এজন্যই বাজারে এ অস্থিরতা।
মানা হচ্ছে না সরকার নির্ধারিত দর
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বসে ভোজ্য তেলের দর নির্ধারণ করে দিলেও তা কখনোই মানা হয় না। সর্বশেষ গত ৬ ফেব্রুয়ারি সরকার নির্ধারিত দর অনুযায়ী বর্তমানে বোতলজাত প্রতি লিটার সয়াবিন তেল ১৬৮ টাকা, ৫ লিটার সয়াবিন তেল সর্বোচ্চ ৭৯৫ টাকা, প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন তেল ১৪৩ টাকা ও পামঅয়েল ১৩৩ টাকা বিক্রি হওয়ার কথা। কিন্তু গতকাল বাজারে বোতলজাত প্রতি লিটার সয়াবিন তেল ১৭০ থেকে ১৮০ টাকা, ৫ লিটার সয়াবিন তেল ৭৯৫ থেকে ৮৩০ টাকা, আর পামঅয়েল ১৫৫ থেকে ১৫৮ টাকা লিটার বিক্রি হচ্ছে। আর খোলা সয়াবিনতো পাওয়াই যাচ্ছে না।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ভোজ্য তেল বিপণনকারী একটি কোম্পানির পরিচালক ইত্তেফাককে বলেন, দেশে ভোজ্য তেলের বাজার আমদানি নির্ভর। তাই বিশ্ববাজারে সয়াবিন, পামঅয়েলের দাম বাড়ায় দেশের বাজারেও দাম বাড়বে এটাই স্বাভাবিক। যদি বিশ্ববাজারের দামের সঙ্গে মিলিয়ে দেশে যৌক্তিক দাম নির্ধারণ করা না হয়, তাহলে সরবরাহে ঘাটতি তৈরি হতে পারে। মৌলভীবাজার ব্যবসায়ী সমিতির নেতা গোলাম মাওলা জানিয়েছেন, বাজারে চাহিদার তুলনায় তেলের সরবরাহ কম। ফলে একধরনের অস্থিরতা কাজ করছে।
এদিকে ভোজ্য তেলের বাজারের এই অস্থিরতার কারণ খতিয়ে দেখতে সব রিফাইনারি প্রতিষ্ঠানের কাছে ভোজ্য তেলের আমদানি, মজুত ও রিফাইনের পরিমাণ জানতে চেয়ে চিঠি দিয়েছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। চিঠিতে গত তিন মাসে কী পরিমাণ ভোজ্য তেল আমদানি করা হয়েছে, কত পরিমাণ রিফাইন (পরিশোধন) হয়েছে, তা কাস্টমস পেপারসহ চাওয়া হয়েছে। এছাড়া প্রতিষ্ঠানগুলো কত ডিও/এসও দিয়েছে, এর মধ্যে কত ডেলিভারি করেছে এবং তাদের সর্বশেষ মজুত সম্পর্কেও জানতে চাওয়া হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব এ এইচ এম সফিকুজ্জামান গতকাল ইত্তেফাককে বলেন, কারা ভোজ্য তেলের বাজারে অস্থিরতা তৈরি করছে, এ ব্যাপারে আমাদের কাছে তথ্য আছে। আমরা আগামীকাল রবিবার থেকে অ্যাকশনে যাচ্ছি। তিনি বলেন, বাজারের কোথায় ম্যানিপুলেট (কারসাজি) হচ্ছে, কারা এর সঙ্গে জড়িত। মিলার না ডিলাররা এসবই খুঁজে বের করা হবে। কাউকে বাজারে অস্থিরতা তৈরির সুযোগ দেওয়া হবে না।