১৮ রুটে হচ্ছে মানব পাচার, খরচ ৩ থেকে ১৫ লাখ টাকা
মানব পাচার রোধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তদারকি বাড়লেও থেমে নেই পাচারকারীরা। প্রায়ই সংবাদ শিরোনাম হচ্ছে, দালালের হাত ধরে ইতালি ও স্পেনে প্রবেশের চেষ্টায় ভূমধ্যসাগরে ডুবে শত শত অভিবাসনপ্রত্যাশীর করুণ মৃত্যু। ইউরোপে ঢোকার আশায় বলকানের বরফঢাকা জঙ্গলে হাজারো মানুষ মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে অপেক্ষায় থাকার সংবাদও আসে। অন্যদিকে দালালের খপ্পরে পড়া হাজারো মেয়ে ভারতে পাচার হয়ে নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন।
বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, দেশ থেকে অন্তত ১৮টি রুটে মানব পাচার হচ্ছে বিদেশে। প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, সাগরপথে ইউরোপে যাওয়ার চেষ্টাকারীদের মধ্যে বাংলাদেশিরা এখন শীর্ষে! ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচি জানিয়েছে, অবৈধ পথে ইউরোপে প্রবেশকারীদের বেশির ভাগই ২৫ থেকে ৪০ বছরের। ইউরোপ ও লিবিয়া থেকে ফেরত আসা ২ হাজার ২৮৪ জনের সাক্ষাত্কারে জানা গেছে, তারা জনপ্রতি ৩ থেকে ১৫ লাখ টাকা খরচ করেছেন বিদেশযাত্রায়।
সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার মুহাম্মদ সাইদুর রহমান খান বলেন, ‘আমাদের হাতে মানব পাচারসংক্রান্ত যেসব মামলা আছে, সেগুলো গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করে যাচ্ছি। পাচার হয়ে যাওয়া অনেকেই এখন দেশে ফিরছেন।’ তিনি বলেন, ‘তবে আগে যত অভিযোগ পাওয়া যেত, তার তুলনায় এখন অভিযোগ কিছুটা কমেছে। কিন্তু পাচার কমেছে এটা বলার সুযোগ নেই। তবে আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি।’
সিআইডির এই কর্মকর্তা বলেন, ২০২০ সালের মে মাসে লিবিয়ার মিজদা শহরে বন্দিশিবিরে গুলি করে ২৬ বাংলাদেশিকে হত্যা করে অপহরণকারীরা। গুলিবিদ্ধ হলেও প্রাণে বেঁচে যান ১২ জন। হতাহতের ঘটনায় দেশের বিভিন্ন থানায় ২৫টি মামলা করে তাদের পরিবার। এর মধ্যে ২৪টি মামলার চার্জশিট দেওয়া হয়েছে আদালতে। একটি মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে। চার্জশিটে মোট আসামি ২৮৮ জন। এর মধ্যে ১৫৩ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। পলাতকদের মধ্যে ছয় জনের বিরুদ্ধে ইন্টারপোলের মাধ্যমে রেড নোটিশ দিয়েছে সিআইডি।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপ-কমিশনার (গুলশান বিভাগ) মশিউর রহমান সম্প্রতি ইরাকে পাচারকারী একটি চক্রের দুই সহযোগীকে গ্রেফতার করেছেন। গ্রেফতারকৃতদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যের সূত্র ধরে এ গোয়েন্দা কর্মকর্তার বলেন, মানব পাচার কমেছে, এটা বলার সুযোগ নেই নেই। তবে সরকারের নজরদারি আগের তুলনায় বেড়েছে। তিনি বলেন, লোভে পড়েই মানুষ পাচার হচ্ছে। গত আট বছরে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়েছে সাড়ে ২০ লাখ পাচার হওয়া মানুষ। এ সময় ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে গিয়ে নৌযান ডুবে ১৯ হাজারের বেশি মানুষ মারা গেছে। ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেওয়া এবং সাগরে ডুবে যাওয়া বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানুষের মধ্যে বাংলাদেশিরাও আছে। শুধু তাই নয়, ভূমধ্যসাগর দিয়ে যত মানুষ ইউরোপে প্রবেশ করার চেষ্টা করে, সেই তালিকার শীর্ষ দশে আছে বাংলাদেশের নাম। জাতিসংঘ মানবাধিকার সংস্হা ইউএনএইচসিআরের প্রতিবেদনে মানব পাচার সম্পর্কে এ ধরনের তথ্যের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডির তদন্তে উঠে এসেছে, সারা দেশের অন্তত ১৫ জেলায় মানব পাচারের নেটওয়ার্ক বিস্তৃত।
সিআইডির তদন্তে উঠে এসেছে, লিবিয়ায় মানব পাচারের সঙ্গে দেশের ১৫ জেলার ১৪ চক্রের ৩ শতাধিক ব্যক্তি জড়িত। প্রতিটি চক্রে অন্তত ২৫ জন করে সদস্য সক্রিয় আছে। মানব পাচার চক্রগুলো ঢাকা, সিলেট, সুনামগঞ্জ, মাদারীপুর, কিশোরগঞ্জ, গোপালগঞ্জ, শরীয়তপুর, নোয়াখালী, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ফরিদপুর, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, নড়াইল, বরগুনায় সক্রিয় রয়েছে।
লিবিয়ায় ২০২০ সালে পাচার হওয়া ২৬ বাংলাদেশি নির্মম নির্যাতনে নিহত হওয়ার ঘটনা তদন্তে এক বাংলাদেশির দুঃসহ অভিজ্ঞতার কথা বের হয়ে এসেছে তদন্তে।
১৯ বছর বয়সে কাজের খোঁজে লিবিয়ার উদ্দেশে ঝুঁকিপূর্ণ যাত্রা শুরু করেন ঐ তরুণ। এ জন্য দালালের মাধ্যমে তার ভুয়া পাসপোর্ট তৈরি করা হয়, যেখানে তার বয়স দেখানো হয় ২১ বছর। লিবিয়ায় গিয়ে কাজ করে ধনী হওয়ার জন্য প্রলুব্ধ করা হয় তাকে। বলা হয়, সেখানে কাজ করে হাজার হাজার টাকা আয় করতে পারবেন। কিন্তু লিবিয়ায় যাওয়া মানুষের দুর্দশা, নির্যাতন, নিপীড়ন বা ঝুঁকি সম্পর্কে তাকে কিছু জানানো হয়নি।
প্রথমে ঐ তরুণকে ঢাকা থেকে বাসে কলকাতায় নিয়ে যাওয়া হয়। পরে বিভিন্ন ফ্লাইটে মুম্বাই, দুবাই, কায়রো হয়ে লিবিয়ায়। লিবিয়ায় যাওয়ার পরেই আরো টাকা আদায়ের জন্য তাকে একটি কারাগারে আটকে ফেলা হয়। যাওয়ার সময় একটি গরু বিক্রি করেছিলেন ঐ তরুণ, এবার বাকি দুটি গরু বিক্রি করে তার মুক্তিপণ দেয় পরিবার। যেখানে তাকে রাখা হয়েছিল, সেখানে তার মতো আরো ১৫ বাংলাদেশি ছিল। সেখান থেকে ছাড়া পেয়ে ত্রিপলির একটি কারখানায় কিছুদিন কাজ করে। কিন্তু সেখানেও তাকে নির্যাতন করা হতো। তখন তিনি আবার পাচারকারীদের সহায়তায় ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। একটি ডিঙিতে করে ৭৯ জন বাংলাদেশির সঙ্গে তিনি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেন। ভূমধ্যসাগর থেকে উদ্ধার করার পর তাদের প্রথমে ল্যাম্পাডুসা দ্বীপে নিয়ে যাওয়া হয়, পরে সিসিলির উপকণ্ঠে পলিমারোর একটি আশ্রয়কেন্দ্রে পাঠানো হয়।