শৈলকুপায় কৃষক ও কৃষি বাঁচাতে জৈব সারের অভাবনীয় সাফল্য
শৈলকুপা (ঝিনাইদহ) প্রতিনিধি ঃ
ছোটবেলা থেকেই মনে মনে স্বপ্ন দেখতেন কৃষকদের জন্য একটা কিছু করার আর সেই চিন্তা থেকে কাজ শুরু। এমনিভাবে ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলার রঘুনন্দনপুর গ্রামের শিক্ষিত যুবক মনিরুজ্জামান সজীব নামের একজন ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা ২০২০ সালে একটি জৈব সার কারখানা স্থাপন করেন আর নাম দেন হারুন অর্গানিক এগ্রো ফার্ম। এই ফার্মে ২ধরনের জৈব সার তিনি তৈরী করছেন, একটি হলো ট্রাইকো কম্পোষ্ট আরেকটি হলো ভার্মি কম্পোষ্ট।তিনি এখান থেকে নিয়মিত জৈব সার উৎপাদন ও সরবরাহ করছেন। উদ্যোক্তা সজীবের জৈব সার স্থানীয় কৃষকদের মাঝে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। চাহিদা ভাল থাকায় এই সার এখন নিজ জেলা সহ পাশর্^বতী জেলাতেও যাচ্ছে।
সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, তিনটা টিন সেটে ঘরের মধ্যে হারুন অর্গানিক এগ্রো ফার্মের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। প্রতিদিন ১৫ থেকে ২০ জন শ্রমিক কাজ করে যাচ্ছে এফার্মে। জৈব সার ট্রাইকো কম্পোষ্ট উৎপাদনে যে সমস্থ কাঁচামাল লাগে তার মধ্যে ট্রাইকো ডার্মা পাউডার,গরুর গোবর, প্রেস মাড-আখের গাদ, কলাগাছ, কচুরপিানা, ছাই,খৈইল, চিটাগুড়,কাঠের গুড়া,সবজীর উচ্ছিষ্ট, ডিমের খোসা, নিম খৈইল, হাড়ের গুড়া, শিং কুচি, গাছের পাতা পচা, ব্যবহৃত চা পাতা সহ ইত্যাদি । এগুলো একত্রিত করে পর্যায়ক্রমে সেডে পচন ্এর মাধ্যমে ৪৫-৫৫ দিনের মধ্যে উৎকৃষ্ট মানের জৈব সার বানানো হচ্ছে।
আর ভার্মি কম্পোষ্ট বা কেঁচো কম্পোষ্টে ব্যবহার করেছেন গরুর গোবর, কলাগাছ ও কচুরিপানা । কেঁচো এগুলো খেয়ে যে মল ত্যাগ করে তাই উৎকৃষ্ট মানের জৈব সার। এসব জৈব সারে পিএইচ, জৈব কার্বন, নাইট্রোজেন, ফসফরাস, পটাশিয়াম, কপার, সালফার, জিংক, ক্যালসিয়াম, আয়রণ ও ম্যাগনেশিয়াম সহ রয়েছে নানা বৈজ্ঞানিক উপাদান ।
তাছাড়া জৈব সার উৎপাদন এবং সরবরাহের ক্ষেত্রে যে আইনগত প্রক্রিয়া রয়েছে তা শিথিলের দাবি এই ক্ষুদ্র উদ্যোক্তার কারণ ট্্েরড লাইসেন্স,ফায়ার লাইসেন্স,বিসিক লাইসেন্স, পরিবেশ অধিদপ্তরের লাইসেন্স, সার সমিতির লাইসেন্স এবং খামার বাড়ির লাইসেন্স লাগে সরকারী অনুমোদন নিতে যা একজন কৃষক বা ক্ষুদ্্র উদ্যোক্তার কাজে অনেক সময় বাধা হয়ে দ্ঁাঁড়ায়। যদি শর্ত শিথিল করে কৃষি অফিসের তদারকিতে জৈব সার উৎপাদন ও সার সরবরাহের ব্যবস্থা করা হলে রাসায়নিক সারের উপর নির্ভরতা কমতে পারে । এছাড়াও জৈব সারের মান পরীক্ষা করার জন্য স্থানীয় বা জেলা পর্যায়ে পরীক্ষাগার করা উচিত। কারণ প্রতিবার জৈব সারের মান পরীক্ষার জন্য একজন উদ্যোক্তাকে বিভাগীয় শহর বা ঢাকা থেকে পরীক্ষা করাতে হয় এবং ফি এর পরিমানও বেশী বলে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের অভিযোগ।
উদ্দ্যোক্তা মনিরুজ্জামান সজীব বলেন, আমার ফার্মে প্রতিমাসে ৫০টন ট্রাইকো কম্পোষ্ট ও ৫টন ভার্মি বা কেঁচো কম্পোষ্ট তৈরীর সক্ষমতা রয়েছে কিন্তু পর্যাপ্ত কাঁচামালের অভাবে বর্তমানে ১৫টন ট্রাইকো কম্পোষ্ট ও ৩টন কেঁচো কম্পোষ্ট উৎপাদন হচ্ছে । এই সার উৎপাদনের অন্যতম কাঁচামাল হচ্ছে গোবর । তবে তার নিজস্ব গরুর খামার না থাকায় বা এলাকায় স্থানীয়দের তেমন খামার না থাকায় ব্যহত হচ্ছে উৎপাদন। প্রাণী সম্পদ অধিদপ্তর, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, যুব উন্নয়ন অফিস বা সরকারের অন্যান্য দপ্তর থেকে এই উদ্যোক্তাকে সহজ শর্তে জামানত বিহীন লোনের সুযোগ করে দিলে নিজস্ব গরুর খামার করে কাঁচামালের চাহিদা পূরণ করতে পারবেন
তিনি আরো জানান, জৈব সার প্রতি শতকে সবজির জন্যে ৫ কেজি, পিয়াজ,আলু,ধান,গম,পাট সহ অন্যান্য ফসলের জন্য ৩ থেকে ৪ কেজি, মাছে বিঘা প্রতি ৪০ থেকে ৬০ কেজি, ফল গাছে ৫ থেকে ৭ কেজি করে ব্যবহার করা যায় । এছাড়াও সব ফসলে সব সময় এই জৈব সার ব্যবহার করা যায় ।সাধারণত স্থানীয় বা উপজেলা কৃষি অফিস যে জৈব সার ক্রয় করে, মান যাচাই-বাছায় করে তা ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের কাছ থেকে কেনার ব্যবস্থা করলে বাড়বে উদ্যোক্তার সংখ্যা, কমবে ক্ষতিকর রাসায়নিক সারের উপর নির্ভরতা।
স্থানীয় কৃষকরা জানায়, এমন জৈব সারের রয়েছে নানা উপকারিতা। ফলন বৃদ্ধি ও গুনগত মান বাড়ায়, সব ঋতুতে সকল ফসলে ব্যবহার করা যায়, জৈব সার বীজের অংকুরোদগমে সহায়তা করে, মাটির তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে, মাটির গঠন ও প্রকৃত গুন রক্ষা করে, মাটির উপকারী জীবানুগুলোর বংশবৃদ্ধি ও কার্যকারিতা বাড়ায়, মাটিতে রস মজুদ রাখতে সহায়তা করে, ফলে অধিক সেচের প্রয়োজন হয় না। জৈব সার ব্যবহারের ফলে আনুপাতিক হারে রাসায়নিক সারের মাত্রা কমানো যায়, মাটির ভেতরে বাতাস চলাচলে সহায্য করে, ফসলের সকল প্রকার খাদ্য যোগান দেয়। এই সার মাটিতে দেয়ার পর ৬ থেকে ১৮মাস পর্যন্ত প্রভাব থাকে যা পরবর্তী ফসলের জন্যেও কাজে লাগে ।
এসবের বিপরীতে কৃষিজমিতে রাসায়নিক সার ব্যবহারে রয়েছে নানাবিধ ক্ষতি। রাসায়নিক সারে মাটির জৈব শক্তি দিনকে দিন কমে যায়, ফলে কৃষকেরা রাসায়নিক সার বেশী ব্যবহার করলেও তাতে ক্ষতির পরিমান আরো বেড়ে যায় । রাসায়নিক সারে যে ফসল উৎপাদন করা হয় তা মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয় । এই সার আমদানী নির্ভর ও ফসলের উৎপাদন খরচ বাড়িয়ে দেয়, সেচ খরচ বৃদ্ধি পায়। রাসায়নিক সারের দাম বেশী, মানুষের স্বাস্থ্যগত ক্ষতি ও ঝুকি বেশী, পরিবেশেও হারায় ভারসাম্য এমনটি জানান কৃষি অফিসের কর্মকর্তারা ।
হারুন অর্গানিক এগ্রো ফার্মের ম্যানেজার রবিন হোসেন জানান, প্রতি কেজি জৈব সারের উৎপাদন খরচ গড়ে ১০ টাকার উপরে। কিন্তু স্থানীয় কৃষকদের এই সার ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করার জন্য এবং অন্যান্য বড় বড় জৈব সার উৎপাদনকারী প্রতিষ্টানের কম মুল্যে সার বিক্রি করার জন্য ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদেরও কম মুল্যে সার বিক্রি করতে হচ্ছে বলে জানান। যার ফলে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা আশার আলো দেখতে পায় না। ১৩ থেকে ১৫ টাকা দরে প্রতি কেজি বিক্রি হলে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা উৎসাহিত হবে তিনি জানান।
জৈব সার ব্যবসায়ী মাগুরা এলাকার সৌরভ বলেন, আমি এই ফার্ম থেকে সার ক্রয় করে থাকি ।কৃষকেরা কম মূল্যে এই পরিবেশ বান্ধব এবং নিরাপদ জৈব সার পেয়ে অনেক উপকৃত হচ্ছেন। এটা একটি কৃষিবান্ধব সার । এ সার প্রয়োগে কৃষকরা লাভবান হবে বলে আমার মনে হয়। কৃষক ও কৃষি বাঁচাতে এ সারের বিকল্প নেই।
উপজেলার পাচপাখিয়া গ্রামের কৃষক তাজনুর রহমান টিটো বলেন, আমি হারুন এগ্রো ফার্ম থেকে সস্পূর্ণ জৈব সার ব্যবহার করে একটি লেবু বাগান করেছি। আমি কোন রাসায়নিক সার প্রয়োগ করেনি। জৈব সার ব্যবহার করে আমি অনেক উপকার পেয়েছি। রাসায়নিক সারের থেকে দাম কম বলে এই জৈব সার ব্যবহার করছি। মাটির উর্বরতা বৃদ্ধিতে এ সারের তুলনা হয় না।
শৈলকুপা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ডঃ মাহফুজুর রহমান জানান, শৈলকুপায় হারুন এগ্রো ফার্ম গড়ে উঠায় তা কৃষকদের জন্য সুখবর। কৃষকদের জৈব সার ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে, ট্রেনিং দেয়া হচ্ছে তাছাড়া উদ্যোক্তাদের কাছ থেকে জৈব সার ক্রয় করা হচ্ছে। তিনি বলেন, উদ্যোক্তা মনিরুজ্জামান সজীব কে সব ধরনের টেকনিকাল সহায়তা করা হচ্ছে ।
অনেকের ধারণা, জৈব সার উৎপাদনে উদ্যোক্তাদের সহজ শর্তে লোন সহায়তা ও সরকারী-বেসরকারী ভাবে কৃষকদের সার ব্যবহারে সচেতনা সৃষ্টির পাশাপাশি সার বিক্রির জন্য জৈব সারের পরিমান ও মূল্য নির্ধারন যদি করে দেয় তাহলে কৃষকারা এই সার ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ হবে ও উপকৃত হবে। আর উদ্যোক্তা মনিরুজ্জামান সজীবের মতো অনেক উদ্যোক্তারা জৈব সার উৎপাদনে আগ্রহী হবেন আর নির্ভরতা কমবে রাসায়নিক সারের উপর।