ঝিনাইদহ পৌরসভা নির্বাচনে নৌকার ভরাডুবির কারণ কি ?

Share Now..


আসিফ কাজল, ঝিনাইদহ
সাত হাজারের বেশি ভোটে হেরে যাওয়া নৌকার প্রার্থীকে নিয়ে এখন শহরময় চুলচেরা বিশ্লেষন চলছে। ঝিনাইদহ শহরের চায়ের স্টল ও বিভিন্ন রজনৈতিক ট্রেন্ডে নৌকার ভরাডুবির বিষয়টি এখন আলোচনার প্রধান খেরাক। নৌকার সমর্থক ও সরকার দলীয় নেতাকর্মীদের মাঝে হাজারো প্রশ্ন উঠছে এই ভরাডুবি নিয়ে। কারণ হিসেবে তারা তুলে ধরছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী কাইয়ুম শাহরিয়ার জাহিদী হিজল রাজনৈতিক পরিবারের সদস্য হলেও তিনি ব্যক্তিগত ভাবে অরাজনৈতিক ছিলেন।

তার বড় ভাই শাহরিয়ার জাহেদী মহুল জেলা আওয়ামলীগের সহ-সভাপতি হলে প্রার্থী হিজল পদধারী কোন নেতাও ছিলেন না। তাহলে কেন স্বতন্ত্র প্রার্থীর কাছে পরাজিত হলো নৌকা ? জাহিদী পরিবারের কি এতো প্রভাব পতিপত্তি কাজ করেছে যে, একটি পরিবারের ইমেজের কাছে দলের প্রার্থী বিপুল ভোটের ব্যবধানে হেরে গেলো ? রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, সদ্য সমাপ্ত পৌর নির্বাচনে ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামীলীগ ঐক্যবদ্ধ ছিল না। নেতাদের মধ্যে ছিল ব্যক্তিগত দ্বন্দ, পরস্পরের প্রতি অবিশ^াস, ক্ষোভ ও লোভ। জেলা, উপজেলা ও পৌর কমিটির বিভিন্ন ইউনিটের নেতাকর্মীরা প্রথম দিকে ঐক্যবদ্ধ থাকলেও আইনী জটিলতায় প্রায় তিনমাস ভোট বন্ধ থাকার কারণে সাজানো ভোটের মাঠ অনেকটাই এলোমেলা হয়ে যায়। দলের প্রভাবশালী কতিপয় নেতা ভোটের মাঠে ছিলেন কৌশলী। ফলে এমপি ও সাবেক মেয়রের সেই পুরানো দ্বন্দ আবারো সামনে চলে আসে। নির্বাচনী মাঠে স্থানীয় এমপি ও তার সমর্থকরা নিষ্ঠাবান থাকলেও গত ১২ জুন স্বতন্ত্র প্রার্থীর উপর হামলা ও বাড়িঘরে আক্রমন, ভোটের দিন নারিকেল গাছ প্রতিকের নির্বাচনী অফিস ভাংচুরের বিষয়টি ভোটাররা ভালো চোখে দেখেনি। শহরে এই আতংক সৃষ্টির রাজনীতির এই সুযোগটি কাজে লাগিয়ে নৌকার মাঠ তছনছ করে দেয় নারিকেল গাছ প্রতিকের প্রার্থী কাইয়ুম শাহরিয়ার জাহিদী হিজল। এমন হাজারো যুক্তি ও মুখরোচক আলোচনা দিনভর শোনা গেলেও বাস্তবতা ছিল ভিন্ন। বিশ্লেষকদের মতে, ঝিনাইদহ পৌরসভা এলাকায় সচেতন মানুষের বসবাস। নানা পেশার মানুষ শহরের ভোটার থাকলেও এরমধ্যে ৩৮% শাতাংশ নৌকার সমর্থক বলে বিভিন্ন ভোটে প্রতিয়মান হয়। বাকীরা বিএনপি, জামায়াত, ভাসমান ও অন্যান্য দলের সমর্থক হিসেবে চিহ্নিত। সেই হিসেবে আওয়ামীলীগ নেতাদের ব্যক্তিগত দ্বন্দ, পরস্পরের প্রতি অবিশ^াস ও ক্ষোভের কারণে ৩৮% শতাংশ ভোটে প্রভাব পড়েছে। নিজেদের ভোট ব্যাংকে ভাগ বসিয়েছে স্বতন্ত্র প্রার্থী এমন কথাও শোনা যাচ্ছে। তাছাড়া বিএনপি ও জামায়াতের ভোটে জয় পরাজয়ের পার্থক্য গড়ে দিয়েছে। গত পৌরসভা নির্বাচনে নৌকার প্রার্থী আব্দুল খালেক বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে মাঠে ছিলেন। তিনি কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে তাৎকালীর নৌকার প্রার্থীর বিরুদ্ধে ভোট করেন। সেই পুরানো কথা যদি দলের পোড়া খাওয়া নেতারা মনে রাখেন তাহলে নৌকার বিপর্যয় অনিবার্য্য হবে এটা ধরে নেওয়া যায়। প্রায় সাড়ে ১১ বছর আগে মেয়র নির্বাচনের পার দলীয় প্রার্থী ঝিনাইদহ শহরে একচ্ছত্র আধিপত্য গড়ে তোলে। নতুন করে কোন ট্যাক্স বা কর না বাড়ানোর ঘোষনা দিলেও ধাপে ধাপে পৌরবাসির কাঁধে চেপে সবে ট্যাক্স, কর, পানির বিল, জন্ম-মৃত্যু সনদ, বাড়ির প্লান, জমি জরিপ ফি ও তালাক বিয়ের শালিস ফির টাকা। পাড়ায় পাড়ায় ইট, বালি ও সেফটি ট্যাংক করা নিয়েও নাগরিকদের কাছ থেকে জরিমানা বাবদ বাড়তি টাকা আদায় করা হয়। শহরের আরাপপুর, নতুন হাটখোলা, পাগলাকানাই ও ডাইভারশান রোডে ট্রাক টার্মিনালে ঘর বরাদ্দ, বিক্রি ও তৈরী নিয়ে নয়ছয় করা হয়। সেই টাকা পৌর ফান্ডে হয়নি। বিশেষ করে ট্রাক টার্মিনালে পৌর মার্কেট সড়ক বিভাগ গুড়িয়ে দিয়ে বিষয়টি ফাঁস হয়ে পড়ে। তাছাড়া পৌরসভার ফান্ডের প্রায় কোটি টাকা জালিয়াতির মাধ্যমে তুলে নেওয়া হলেও দায়ীদের কোন বিচার হয়নি। এই অনিয়ম দুর্নীতির খবর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, পত্রিকা ও টিভি চ্যানেলে প্রচার হওয়ার পর দলীয় প্রার্থীর বিষয়ে ভোটারদের মাঝে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। তাছাড়া ভোটবিহীন সাড়ে ১১ বছরের ঝিনাইদহ পৌর পরিষদকে টেনে আনার পেছনেও দলীয় কারসাজিকে দায়ী করা হয়। গত সাড়ে ১১ বছর জেলা শহরের পাড়া মহল্লায় ড্রেন, রাস্তা ও ময়লা আবর্জনার সুষ্ঠ কোন ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। বেশির ভাগ মহল্লায় নতুন রাস্তা করা যায়নি। কোটি কোটি টাকার ড্রেন তৈরী করা হলেও তা কাজে আসিনে। নির্মিত ড্রেন ও রাস্তাগুলো ২/১ বছরের মধ্যে নষ্ট হয়ে গেছে। সামান্য বৃষ্টি হলেই শহরে হাটু পানি জমা হয়। তাছাড়া পৌরসভার মধ্যে পানির কল স্থাপন করতে বিপুল পরিমান টাকা আদায় করা হয়েছে। পানির লাইন কাটতে হলেও গুনতে হয়েছে বাড়তি টাকা। অথচ এসবের কোন নিয়ম বা আইনী ভিত্তি ছিলনা। পৌরসভার নাগরিকদের মধ্যে এ নিয়ে দীর্ঘদিনের পঞ্জিভুত ক্ষোভ নির্বাচনে প্রভাব ফেলেছে। যদিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশির ভাগ নেতাকর্মী আকার ইঙ্গিতে জেলা নেতাদের দায়ী করছেন। তাদের ফেসবুকের স্ট্যাটাসও ফেলে দেওয়ার নয়। তবে নৌকার পরাজয় নিয়ে জেলা নেতারা কেউ এখনো মুখ খোলেননি। অনেকের মুঠোফোনে নৌকার ভরাডুবির কারণ কি জ্ঞিাসা করলে তারা বক্তব্য দিতে রাজি হননি। এদিকে স্বতন্ত্র প্রার্থী কাইয়ুম শাহরিয়ার জাহিদী হিজলের পরিবার বহু বছর ধরে সাধারণ ও হতদরিদ্র মানুষের চাল, ডাল, চিনি, সেমাই ও কোরবানীর পশুর গোস্ত দিয়ে সহায়তা করে আসছে। ওই পরিবারের সাহায্যের কার্ড জেলা শহরের এমন কোন রাজনৈতিক নেতা নেই যে তারা পাননা। তালিকা করে আওয়ামীলীগ, বিএনপি, জামায়াত, ব্যবসায়ী, সাংস্কৃতিককর্মী, সাংবাদিক, প্রশাসনের লোকজনের বাড়ি বাড়ি পৌছে দিয়েছেন। শহরের ছিন্নমুল পরিবারের হাজারো সদস্য বছরে দুইবার সাহায্য পেয়ে কৃতার্থ হয়েছেন। জেলা ও বিভিন্ন উপজেলার শত শত শিক্ষিত বেকার যুবকদের তাদের নিজত্ব ওষুধ কোম্পানীতে চাকরী দিয়েছেন। এছাড়া জেলায় মসজিদ, মাদ্রাসা ও স্কুল কলেজ নির্মানে কোটি কোটি টাকা ব্যায় করেছেন স্বতন্ত্র প্রার্থীর পরিবার। ক্রীড়া ও সাংস্কৃতির অঙ্গনে রয়েছে তাদের অবদান। এই পরিবারটি দিনে দিনে তাদের ব্যক্তিগত ইমেজ কাজে লাগিয়ে গড়ে তোলে বৃহৎ ও শক্তিশালী জনমত। তাদের সঙ্গে যদি ভোটে না আসা রাজনৈতিক দলের সমর্থন যোগ হয় সেক্ষেত্রে নৌকার ভরাডুবি অবশ্যম্ভাবি হয়ে ওঠে।

One thought on “ঝিনাইদহ পৌরসভা নির্বাচনে নৌকার ভরাডুবির কারণ কি ?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *