গাজার আল শিফা হাসপাতাল কেন ইসরায়েলের হামলার কেন্দ্রবিন্দু

Share Now..

গাজার সবচেয়ে বড় হাসপাতাল আল শিফা। হাসপাতালটি সামরিক বাহিনী ও সাঁজোয়া যান দিয়ে ঘিরে রেখেছে ইসরায়েলি সেনারা। পর্যাপ্ত জ্বালানি ও বিদ্যুতের অভাবে সকল পরিষেবা বন্ধ হয়ে আছে হাসপাতালটিতে। আইসিইউতে থাকা শিশু এবং বৃদ্ধরা মারা যাচ্ছে। কিন্তু কেন এই হাসপাতালই ইসরায়েলের মূল লক্ষ্য?

গাজার ফিলিস্তিনিদের জন্য হাসপাতালটি ‘নিরাময়ের ঘর’ আর ইসরায়েলের কাছে এটি হামাসের প্রধান কমান্ড সেন্টার। গত সপ্তাহে হাসপাতালের সামনে থাকা একটি অ্যাম্বুলেন্সে বোমা হামলা করেছে ইসরায়েলি সেনারা। অ্যাম্বুলেন্সটি দিয়ে গাজা শহর থেকে রাফাহ সীমান্ত ক্রসিং পর্যন্ত রোগীদের নিয়ে যাওয়া হতো যেন তারা মিসরে চিকিৎসা নিতে পারে।

ফিলিস্তিনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মতে, ওই হামলায় ১৫ জন নিহত হয়েছে, যারা গাজায় ইন্টারন্যাশনাল কমিটি অব রেড ক্রসের (আইসিআরসি) সঙ্গে যাত্রার সমন্বয় করতো। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) বলেছে, অ্যাম্বুলেন্সের ভেতরে ও আশপাশে লোকজনের প্রাণ নেওয়া এই হামলাকে সম্ভাব্য যুদ্ধাপরাধ হিসেবে তদন্ত করা উচিত।

আল-শিফা কী

দার আল-শিফা, আক্ষরিক অর্থে ‘নিরাময়ের ঘর’। এটি গাজার বৃহত্তম এবং সবচেয়ে বিস্তৃত মেডিকেল কমপ্লেক্স, যেখানে তিনটি বিশেষ সুবিধা রয়েছে— অস্ত্রোপচার, অভ্যন্তরীণ ওষুধ এবং প্রসূতি ও স্ত্রীরোগবিদ্যা।

বন্দরের কাছাকাছি অবস্থিত এই স্থপানাটিতে মূলত ব্রিটিশ আর্মি ব্যারাক ছিল। পরে মিসরীয় শাসনের অধীনে ১৯৪৬ সালে এটিকে হাসপাতালে পরিণত করা হয় এবং ১৯৮০ এর দশকে ইসরায়েলি দখলের সময় ধারাবাহিকভাবে এটিকে বড় করা হয়। ধীরে ধীরে জরুরি চিকিৎসা প্রয়োজন এমন মানুষের কাছে হাসপাতালটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।

ডক্টরস উইদাউট বর্ডারস-এর একটি সাম্প্রতিক প্রতিবেদন অনুসারে, হাসপাতালটিতে একসঙ্গে ৭০০ রোগীর চিকিৎসা করার সক্ষমতা রয়েছে, কিন্তু বর্তমানে ডাক্তাররা আনুমানিক ৫ হাজার জনের চিকিৎসা করছেন। যুদ্ধে ঘরবাড়ি হারিয়ে হাজার হাজার মানুষ হাসপাতালের বারান্দায় ও উঠানে আশ্রয় নিয়েছে।

হাসপাতালের সার্জারির প্রধান ডা. মারওয়ান আবুসাদা বলেছেন, আল-শিফা সাধারণত ২১০ শয্যা দিতে পারে। কিন্তু বর্তমানে ৮০০ জন রোগী ভর্তির জন্য অপেক্ষা করছেন। হাসপাতালে জনবলও কম। ইসরায়েলি বিমান হামলায় ওই অঞ্চলে ১৫০ জন চিকিৎসা কর্মী নিহত হয়েছে।

এখানে বারবার হামলা কেনো

আল-শিফা হল ইসরায়েলি বাহিনীর প্রধান টার্গেট। তাদের দাবি, হাসপাতালটির নীচে হামাসের সদর দপ্তর রয়েছে।

গত মাসে, ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী একটি ভিডিও প্রকাশ করেছে। ভিডিওটিতে স্যাটেলাইট চিত্র এবং অ্যানিমেটেড গ্রাফিক্সের সংমিশ্রণ ছিল। তাদের দাবি, হাসপাতালের নীচে হামাসের সুড়ঙ্গ, সভাকক্ষসহ অন্যান্য সুবিধা থাকার তথ্য প্রমাণ রয়েছে। কিন্তু হামাস সেই দাবিগুলো প্রত্যাখ্যান করেছে। তারা এখানে ৪০ হাজারের বেশি বাস্তুচ্যুত মানুষকে আশ্রয় দেওয়ার দাবি করেছে।

হামাস ও আল শিফা হাসপাতালের মধ্যে যোগসূত্র থাকার ব্যাপারে এবারই প্রথম দাবি করা হয়নি। ২০১৪ সালে গাজায় ইসরায়েলের স্থল অভিযানের পর মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল অভিযোগ করেছিল, হাসপাতালটির পরিত্যক্ত এলাকাগুলোতে রাজনৈতিক বিরোধীদের ওপর নৃশংসতা চালাচ্ছে হামাস। মানবাধিকার সংগঠনটি আরও অভিযোগ করেছিল, গাজায় যুদ্ধাপরাধ করেছে ইসরায়েল।

২০১৪ সালে গাজায় ইসরায়েলি অভিযানের সময়ও হাসপাতালটি হামলার শিকার হয়েছিল। তখন হাসপাতালটিতে বিস্ফোরণে ১০ শিশু নিহত হয়। ওই বিস্ফোরণের জন্য ইসরায়েল ও হামাস একে অপরকে দায়ী করেছিল।

বর্তমান সংঘাতে হামাসকে তার নিজস্ব কর্মকান্ডের জ্বালানী সঞ্চয় করার জন্য অভিযুক্ত করেছে ইসরায়েল। একারণে তারা সীমিত সংখ্যক মানবিক সরবরাহের কাফেলাও উপত্যকায় প্রবেশ করতে বাধা দেয়। এদিকে বিদ্যুৎ না থাকায় গাজা উপত্যকার ৩৫টি হাসপাতালের মধ্যে ১৬টি কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে।

হাসপাতালটির বর্তমান অবস্থা

সপ্তাহান্তে, হাসপাতালটির কর্তৃপক্ষ তাদের প্রসূতি ওয়ার্ড গাজা শহরের বেসরকারি আল হেলো আন্তর্জাতিক হাসপাতালে স্থানান্তর করতে বাধ্য হয়েছিল। জাতিসংঘের জনসংখ্যা তহবিল অনুসারে, ফিলিস্তিনে আনুমানিক ৫০ হাজার গর্ভবতী মহিলা এই সংঘাতের বলি হয়েছে। বোমা হামলার কারণে ভয় ও আতঙ্কের ফলে অকাল প্রসব এবং গর্ভপাত বাড়ছে।

উত্তর গাজায়, যেখানে হাসপাতালটি অবস্থিত, পানির প্রধান উত্স যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে হাসপাতালটি শুধু লবণাক্ত ভূগর্ভস্থ পানি দিয়ে চলছে যা পান ও স্বাস্থ্যের জন্য অনুপযুক্ত। জাতিসংঘের মতে, গাজার পানির চাহিদার মাত্র ৫ শতাংশ পূরণ হচ্ছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *