বড় ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে দেশ

Share Now..
  • ৮ দশমিক ৯ মাত্রার পর্যন্ত ভূমিকম্পের আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের
  • ৫ দশমিক ৫ মাত্রার ভূমিকম্পে কাঁপল দেশ
  •  ভবন থেকে নামতে গিয়ে  চৌদ্দগ্রামে শতাধিক গার্মেন্টস কর্মী আহত
  • ঢাবি মুহসীন হলের ক্ষতি
  • কুবির তিন হলের দেওয়ালে ফাটল

বাংলাদেশ ক্রমশ ভূমিকম্পপ্রবণ হয়ে উঠেছে। মাঝেমধ্যেই ছোট ও মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্পে কেঁপে উঠছে দেশ। এসব ভূমিকম্পে তেমন বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি না হলেও বড় মাত্রার ভূমিকম্পে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। সাম্প্রতিককালে বড় মাত্রার ভূমিকম্প না হলেও ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে ঝুঁকিতে রয়েছে বাংলাদেশ। গতকাল শনিবার সকাল ৯টা ৩৫ মিনিটে মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্পে কেঁপে উঠেছে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল।

যুক্তরাষ্ট্রের ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা ইউএসজিএসের তথ্য অনুসারে, ভূমিকম্পের উৎপত্তি লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জ উপজেলা থেকে ৮ কিলোমিটার উত্তর-পূর্ব-উত্তরে। আর এর গভীরতা ছিল ১০ কিলোমিটার। তবে বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদফতর জানিয়েছে, রিখটার স্কেলে ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৫ দশমিক ৬। ভূমিকম্পটির উৎপত্তি ঢাকা থেকে ৮৬ কিলোমিটার দূরে। ভূমিকম্পের স্থায়িত্ব ছিল প্রায় ৩১ সেকেন্ড। রাজধানীর বাইরে রায়পুরা, ভোলা, খুলনা, কোটালীপাড়া, চট্টগ্রাম, দেবীদ্বার, ঝালকাঠি, বরগুনা, রাজশাহী, সিলেট, রংপুর, চুয়াডাঙ্গা, নোয়াখালী, কুষ্টিয়ায় তীব্র ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। তবে বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি ও হতাহতের কোনো খবর পাওয়া যায়নি। ভূমিকম্পের সময় অনেকেই আতঙ্কে ঘর বাড়ি ভবন থেকে খোলা জায়গায় বেরিয়ে আসেন। স্বজনদের খবর নিতে থাকে থাকেন কেউ কেউ। কিছু কিছু স্থানে বড় বড় ভবনে ফাটল ধরার খবর পাওয়া গেছে। কোথাও কোথাও ঘরের ছাদ ফেটেছে। কোথাও মেঝের টাইলসে ফাটল দেখা গেছে। ভূমিকম্পের সময় হুড়োহুড়ি করে নামতে গিয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক সংলগ্ন কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার ছুপুয়া এলাকায় অবস্থিত আমির শার্ট গার্মেন্টসে শতাধিক কর্মী আহত হয়েছেন। কুমিল্লা মহিলা কলেজে আহত হয়ে চারজন কুমিল্লা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।

ভূমিকম্পে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলের একটি ভবনের বিভিন্ন স্থানের পলেস্তারা খসে পড়েছে। হলের পাঠকক্ষের দরজার কাচ ভেঙে গেছে। হলসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য আবাসিক হলগুলোতে আতঙ্কে ছোটাছুটি শুরু করেন শিক্ষার্থীরা। আতঙ্কে মাস্টারদা সূর্য সেন হলের দোতলার জানালা দিয়ে লাফিয়ে পড়ে আহত হয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র মিনহাজুর রহমান। ভূমিকম্পে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনটি আবাসিক হলের দেওয়ালে ভয়ংকর ফাটল দেখা দিয়েছে। এতে আতঙ্কিত হয়ে পড়েন হলে থাকা শিক্ষার্থীরা। হল তিনটি হলো— বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হল, কাজী নজরুল ইসলাম হল এবং নওয়াব ফয়জুন্নেছা চৌধুরানী হল।

এর আগে সর্বশেষ বাংলাদেশে ভূমিকম্প অনুভূত হয় গত ২ অক্টোবর। সেদিন সন্ধ্যা ৬টা ৪৬ মিনিটে ভূমিকম্প অনুভূত হয় বাংলাদেশে। ওই ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল ভারতের মেঘালয়। রিখটার স্কেলে তার মাত্রা ছিল ৫ দশমিক ৩। ফেব্রুয়ারি থেকে চলতি বছর দশ মাসে ১২ টি ভূমিকম্প হয়েছে যার অধিকাংশের উৎপত্তিস্থল দেশের অভ্যন্তরে অথবা আশপাশে। ভূতত্ত্ব বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভূমিকম্পের তেমন কোনো পূর্বাভাসের ব্যবস্থা নেই। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশ ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা। ইন্ডিয়ান, ইউরোপিয়ান এবং বার্মিজ-এ তিনটি গতিশীল প্লেটের সংযোগস্থলে বাংলাদেশের অবস্থান। বার্মিজ প্লেট ও ইন্ডিয়ান প্লেটের পরস্পরমুখী গতির কারণেই ঘন ঘন এ ধরনের ভূমিকম্প হচ্ছে। এ দুটি প্লেটের সংযোগস্থলে প্রচুর পরিমাণে শক্তি জমে রয়েছে, যেগুলো বের হয়ে আসার পথ খুঁজছে। আগে হোক বা পরে, এই শক্তি বেরিয়ে আসবেই। আর সেটাই জানান দিচ্ছে এই ছোট ভূমিকম্পগুলো।

‘৮ দশমিক ৯ মাত্রা পর্যন্ত ভূমিকম্পের আশংকা’: বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মেহেদী আহমেদ আনসারী বলেন, ছোট ও মাঝারি ভূকম্পনে বড় শক্তি বের হওয়ার একটা প্রবণতার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। তার মানে, যে কোনো সময় একটি বড় ভূমিকম্প সংঘটিত হতে পারে। তবে এই বড় ভূমিকম্প কবে হবে, সেটা নির্দিষ্ট করে বলা যায় না।

ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি প্রফেসর সৈয়দ হুমায়ূন আখতার ভূমিকম্পের এই উৎপত্তিস্থলকে সাবডাকশন জোন (সিলেট থেকে কক্সবাজার অঞ্চল) হিসেবে চিহ্নিত করে বলেছেন, এই জোনে যে বিপুল শক্তি প্রায় হাজার বছর ধরে সঞ্চিত হয়ে আছে, তাতে যেকোনো সময় ৮ দশমিক ২ থেকে ৮ দশমিক ৯ মাত্রা পর্যন্ত ভূমিকম্প হতে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে। ছোটখাটো ভূমিকম্প বড় ভূমিকম্পের পূর্বলক্ষণ।

ড. সৈয়দ হুমায়ুন আখতার বলেন, আমাদের এখনো সময় রয়েছে পরিকল্পনা নেওয়ার। সরকারকে স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিতে হবে। তবে সরকার যে পরিকল্পনা নিচ্ছে, সেটা দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। সেটাতেও কিছুটা ভুল আছে। এ ক্ষেত্রে ভূমিকম্পের পরবর্তী উদ্ধারকাজের জন্য পরিকল্পনা করা হচ্ছে। কিন্তু ক্ষতি যেন না হয়, তার জন্য কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না। ভূমিকম্প হলে কোথায় ক্ষয়ক্ষতি বেশি হতে পারে, কোথায় অগ্রাধিকার ভিত্তিতে উদ্ধারকারী দল ও চিকিৎসক দল দ্রুত পাঠাতে হবে, কোন জায়গাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে, সেগুলো নিয়ে সরকারের কোনো পরিকল্পনা দেখছি না।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতাত্ত্বিক বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি নির্ভর করে কোথায় ভূমিকম্প হয়েছে। অর্থাৎ ভূমিকম্প যে জায়গায় হয়েছে, তার থেকে তার আশেপাশে জনবহুল এলাকা কতদূর। আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকম্প মাটির কত গভীরে হয়েছে এবং কোন মাত্রায় হয়েছে। এই তিনটি বিষয়ের ওপর নির্ভর করে ক্ষয়ক্ষতি। 

ড. মো. সাখাওয়াত হোসেন বলেন, দেশের ৩০ বা ৪০ তলা বিশিষ্ট বিল্ডিংগুলো সাধারণত ৭ বা ৮ মাত্রার ভূমিকম্প সহনশীল করে বানানো হয়। ওইসব বিল্ডিংয়ের জন্য ৫ দশমিক ৬ মাত্রার ভূমিকম্প কোনো বিষয় না। নরমালি ২ বা ৩ অথবা ৫ তলা বিশিষ্ট বিল্ডিংগুলো ৭ মাত্রা ভূমিকম্প সহনশীল করেই বানানো হয়। তবে পুরানো বিল্ডিং বা ডোবা ভরাট করে যে বিল্ডিং করা হয়, ওই বিল্ডিংগুলো এতোটা সহনশীল করে করা হয় না।  

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান বলেন, উদ্ধার কাজের জন্য সিটি করপোরেশনগুলোকে আলাদা অঞ্চলে ভাগ করা হয়েছে। এ সব অঞ্চলে ৩৬ হাজার প্রশিক্ষিত স্বেচ্ছাসেবক প্রস্তুত রাখা হয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *