তবুও আলো ফেলেছে মঞ্চনাটক
পৃথিবীর সব থেকে বড় ডাস্টবিন হল মানুষের মন। এটাকে পরিস্কার রাখলে পৃথিবীও পরিস্কার থাকবে। সংস্কৃতিও তেমন। নাটক, সিনেমা, সঙ্গীতের চেহারা দেখেও একটি দেশকে বুঝে ফেলা সম্ভব। একটু খেয়াল করলেই দেখবেন পৃথিবীর সব দেশে বিদেশী কোন মেহমান এলেই তার বা তাদের সফর সূচিতে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের অগ্রাধিকার থাকে। নাটক, সিনেমা, সঙ্গীতসহ সাংস্কৃতিক অঙ্গনের জনপ্রিয় তারকাদের বিশেষভাবে পরিচয় করিয়ে দেওয়া।
মঞ্চ নাটক দেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের একটি বড় শক্তি হয়ে উঠেছে। বাদল সরকারের লেখা ‘বাকি ইতিহাস’ বাংলাদেশে দর্শনীর বিনিময়ে মঞ্চস্থ করা প্রথম নাটক। ১৯৭৩ সালে নাগরিক নাট্য সম্প্রদায় এই নাটক মঞ্চায়নের মাধ্যমে দেশে দর্শনীয় বিনিময়ে নাটক মঞ্চায়নের সাহস দেখায়। সেই থেকে শুরু। প্রতিবছরই নতুন নতুন নাটকের দল বাড়ছে। গত বছর মঞ্চ পাড়ায় ৫টি নতুন নাটকের দলের আত্মপ্রকাশ ঘটেছে। মঞ্চে এসেছে ৩৪টি নতুন নাটক। উত্সব হয়েছে ১২টি। যারা মঞ্চে জড়িত তারা বোঝেন নাটকের দল চালানো কতটা কঠিন। অর্থ সংকট তো আছেই। আরও আছে ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর মতো কঠিন সংগ্রাম। এমন বাস্তবতায় প্রতিটি দলের নতুন নাটক দলের অনেক আশা আকাঙ্খার প্রতীক হয়ে ওঠে। সব দলই চায় আমার, আমাদের নাটকটি যেন পত্র পত্রিকা অর্থাত্ প্রচার মাধ্যমের আলোচনায় আসে। সে কারণে বছরের শ্রেষ্ঠ নাটক নিয়ে আলোচনা করা একটি দুুরুহ কাজ। আপনি যখন কোনো বিষয় নিয়ে আলোচনা করবেন তখন বিষয়টি সম্পর্কে আপনার সার্বিক ধারণা থাকতে হবে। গত কয়েকদিনে বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে মঞ্চ নাটকের সালতামামি দেখে একজন নাট্যকর্মী হিসেবে নিজেকে প্রশ্ন করেছি বছরে প্রায় ৩৪টি নতুন নাটক মঞ্চে এসেছে। যারা ইতিমধ্যে আলোচনা লিখেছেন তারা কী ৩৪টি নাটক দেখেছন? এই যে আমি মঞ্চ নাটকের আলোচনা লিখছি আমিও কী ৩৪টি নতুন নাটক দেখেছি?
আমাদের দেশে সাধারণত আলোচিত মানুষকে নিয়েই আলোচনা বেশি হয়। নতুনের প্রতি প্রচার মাধ্যমের আগ্রহ যেন একটু কম। নাটকের বড় দল মঞ্চে নতুন নাটক নামাচ্ছে এই সংবাদটি যতটা গুরুত্ব পায় সেই তুলনায় একটি ছোট দলের অসম্ভব একটি ভালো নাটকের প্রচার-প্রচারণা তেমন গুরুত্ব পায় না। এই যে ৩৪টি নতুন নাটকের কথা বলা হল এর মধ্যে ছোটদলের ভালো নাটকটি হয়তো দর্শকপ্রিয়তা পায়নি। সে কারণে প্রচার মাধ্যমের আলোচনাতেও আসেনি। আমাদের এখানে এখনও ভালো নাটকের সংজ্ঞা নির্ধারিত হয় কোন নাটকে কতজন জনপ্রিয় টিভি আর্টিস্ট আছেন। এক্ষেত্রে দর্শকেরও একটা দায় আছে। টিকেট কাউন্টারে এসে প্রথমেই জানতে চায় কতজনআছেন। টিভি আর্টিস্ট বিহীন অনেক ভালো নাটকও আলোচনায় আসে না।
যদিও ‘ভালো’ শব্দটি বেশ আপেক্ষিক। ড্রয়িং রুমে বসে পরিবারের ৫ জন সদস্য হয়তো একটি টিভি নাটক দেখছেন। কেউ আনন্দে হাত তালি দিচ্ছেন। কেউ বেশ বিরক্ত— এটা কোনো নাটক হলো? পারলে টিভি বন্ধ করে দেন। মঞ্চের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। দর্শক সারির একদল বেজায় খুশি। অন্য দল বিরক্ত-এটা কোনো নাটক হলো? নাচ গান কিছুই নাই।
মঞ্চ নাটকের ওপর দেশের দুটি জনপ্রিয় দৈনিক পত্রিকায় পর পর দুটি লেখায় আলোচিত নাটকের নাম দেখে একটু অবাকই হলাম। একটি লেখায় আলোচিত নাটকের ক্ষেত্রে প্রাচ্যনাটের অচলায়তন, থিয়েটার এর লাভ লেটারস, অনুস্বরের হার্মাসিস ক্লিওপেট্রা, স্বপ্নদলের ম্যাকবেথ, হূত্মঞ্চের রিমান্ড, থিয়েটার ফ্যাক্টরির রেসপেক্টফুল প্রস্টিটিউট-এর নাম উল্লেখ করা হয়েছে। আরেকটি লেখায় দেখলাম হলভর্তি দর্শকের কথা বলে চোখে পড়ার মতো নাটকের তালিকায় স্পর্ধার প্রযোজনা সৈয়দ জামিল আহমেদের ‘আমি বীরঙ্গনা বলছি’, থিয়েটারওয়ালার প্রযোজনা সাইফ সুমনের ‘নাজুক মানুষের সংলাপ’ অনুস্বরের প্রযোজনা মোহাম্মদ বারীর, ‘হার্মাসিস ও ক্লিওপেট্রা’ আরশিনগরের প্রযোজনা রেজা আরিফের ‘সিদ্ধার্থ’ নাটকের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। একটু খেয়াল করলেই দেখবেন দুটি আলোচনায় ভালো নাটকের ক্ষেত্রে অভিন্ন ভাবনা গুরুত্ব পায়নি। ভালো নাটকের ক্ষেত্রে একজনের তালিকা থেকে অন্যজনের তালিকায় বিরাট ফারাক। এটা প্রমাণ করে ৩৪টি নতুন নাটকের কিছু ভালো নাটক হয়তো অনেকের চোখে পড়েনি।
এই যে হল ভর্তি দর্শকের কথা বলে ভালো নাটকের নাম উল্লেখ করা হলো। এখানেই প্রশ্ন, হল ভর্তি দর্শকই কি একটি মঞ্চ নাটকের মান নির্ধারণ করে? অনেক মানুষ যখন কিছু দেখেন তখন তা অবশ্যই আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। যা দেখেন না অথবা দেখার সুযোগ পান না সেই নাটক, সিনেমার ভবিষ্যত্ কী? দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, আমাদের দেশে যথার্থ অর্থে নাটক, সিনেমা, সাহিত্যের সমালোচনা করার যোগ্য মানুষ তৈরি হয়নি। একটা সময় সাপ্তাহিক বিচিত্রায় সিনেমার সমালোচনা লিখতেন মাহমুদা চৌধুরী। এরপর এই আসনে তেমন কাউকে দেখা যায়নি। পত্র-পত্রিকাগুলোতে এ ব্যাপারে তেমন আগ্রহও দেখা যায় না। একজন নামকরা বিনোদন সাংবাদিক বললেন, ইদানীংকালে অনেকেই সমালোচনা পছন্দ করেন না। স্তুতি পছন্দ করেন। সমালোচনা করলেই মনক্ষুন্ন হন। পত্রিকার উপর মহলে যোগাযোগ করে অভিযোগ তোলেন। ফলে কেউ আর সমালোচক হয়ে উঠছেন না। বাহ! বাহ! বেশ বেশ বলতেই অভ্যস্থ হচ্ছেন অনেকে। এতে ঝামেলা কম।
দূর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, আমাদের মঞ্চ পাড়ায় সুশীল ধারা এবং সংগ্রামী ধারা নামে দুটি ধারা অর্থাত্ দুটি পক্ষ ক্রীয়াশীল। একদল আছেন অন্য দলের কাজ পছন্দ করতে নারাজ। ওরা কি জানে? আমরাই জানি সব। অন্য পক্ষ বেশ নিরীহ টাইপের। তথাকথিত সুশীলদের চাপে সাহস করে কিছু বলার সাহস পায় না। মঞ্চ নাটকের দলগুলো একটা সময় বৃহত্ পরিবারের উজ্জ্বল আলো ছড়িয়েছিল। এখন আর বৃহত্ পরিবারের অবস্থানে কেউ নাই। গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের অলিখিত বিভক্তিকে এজন্য দায়ী করেন অভিজ্ঞ মহল।
এতকিছুর পরও আমাদের মঞ্চ নাটক দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলছে এটাই স্বস্থির খবর। এক বছরে ৩৪টি নতুন নাটক মঞ্চে এসেছে। এটি আশাব্যঞ্জক সংবাদ। গত বছর আরণ্যকের পঞ্চাশ বছর পূর্তির আয়োজনটি ছিল মঞ্চনাটকের ক্ষেত্রে বেশ উত্সাহব্যঞ্জক। বিশিষ্ট নাট্যব্যক্তিত্ব আলী যাকের নামে নাগরিক নাট্য সম্প্রদায় ‘আলী যাকের নতুনের উত্সব’ শীর্ষক নতুন নাটক নির্মাণের যে সৃজনশীল ধারা চালু করেছে তা গত বছরও নাটক পাড়ায় ব্যাপক উত্সাহ জুগিয়েছে। গঙ্গা যমুনা আন্তর্জাতিক সাংস্কৃতিক উত্সবও গত বছর সাংস্কৃতিক জাগরণের ক্ষেত্রে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। পাশাপাশি বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির উদ্যোগে গণজাগরণের শিল্প আন্দোলন শীর্ষক সাংস্কৃতিক কর্মসূচি নাটক পাড়ায় ব্যাপাক প্রভাব ফেলেছে।
বিশিষ্ট নাট্যব্যক্তিত্ব আসাদুজ্জামান নূর গত বছর সগৌরবে মঞ্চে ফিরেছেন। তাঁর অভিনীত ‘রিমান্ড’ নাটকটি ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। বিশিষ্ট নাট্যব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার ও ফেরদৌসী মজুমদার দম্পতির অভিনয়ে সমৃদ্ধ থিয়েটারের নতুন নাটক ‘লাভ লেটারস’ ছিল তরুণ নাট্যকর্মীর পাশাপাশি দর্শকদের জন্যও ব্যাপক উত্সাহের বিষয়। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্মম হত্যাকাণ্ড নিয়ে লেখা এথিক এর নতুন নাটক ‘নেতা যে রাতে নিহত হলেন’ বেশ আলোচিত ছিল। বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক নাট্যকার ইমদাদুল হক মিলনের বহুল আলোচিত ছোটগল্প ‘নেতা যে রাতে নিহত হলেন’। এছাড়া বটতলার ‘সখী রঙ্গমালা’ তাড়ুয়ার আদম সুরত, বিবেকানন্দ থিয়েটারের উত্তরণ, লোক নাট্যদলের সুন্দর, কণ্ঠশীলনের ‘তাজ মহলের টেন্ডার’ বছরের শেষে মহাকাল নাট্য সম্প্রদায়ের সুরেন্দ্র কুমারীসহ অন্যান্য দলের আরও কিছু নাটক আলোচনায় উঠে এসেছে। সবিনয়ে বলছি এটিকে বিগত বছরের নাটক পাড়ার সার্বিক চিত্র বলা যাবে না। সার্বিক চিত্র পেতে হলে সারা বছর জুড়ে মঞ্চ নাটকের সঙ্গে থাকতে হবে। এজন্য ইত্তেফাক-এর মতো দেশসেরা দৈনিক পত্রিকাটি এখন থেকেই উদ্যোগ নিতে পারে। মঞ্চ নাটকের জয় হোক।
লেখক: প্রখ্যাত সাংবাদিক , নির্মাতা ও নাট্যসংগঠক