১৪শ কোটি টাকার কোরবনির পশু বিক্রি নিয়ে দু-শ্চিন্তায় ১৭হাজার খামারি
লকডাউরের কারনে গরু গুলো ঠিকমতো হাটে নিতে পারবো কি না। হাটে পৌঁছাতে পারবো কি না। গ্রাহকেরা খামারে আসবেন কি না, সেটা নিয়েও চিন্তায় আছেন খামারিরা। কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে এক লক্ষ ৩৩ হাজার ৫শ গরু-ছাগলের সাথে ব্যস্ত সময় পার করছেন ঝিনাইদহের খামারিরা। সকাল সন্ধা কাটছে গরু ও অন্যান্য পশু মোটাতাজা ও পরিচর্যার কাজে। ঈদের সময় যত এগিয়ে আসছে, খামারিদের ব্যস্ততা তত বাড়ছে। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে দুশ্চিন্তা। কোরবানির জন্য লালন-পালন করা ১৪শ কোটি টাকার গরু ও ছাগল গুলোর ন্যায্য দাম ও বিক্রি নিয়ে শঙ্কায় খামারিরা। ঈদুল আযহাকে সামনে রেখে শেষ মুহুর্তে, কোরবানীর এই পশু বিক্রয় নিয়ে জেলার সাড়ে ১৭ হাজার খামারিরা এখন লাভের আশার চেয়ে দু-চিন্তাই বেশি করছে।
ঝিনাইদহ সদর উপজেলার প্রতাপপুর গ্রামের খামারি আজিজুর রহমান। তিনি গত ২৬ মাস ধরে লালন পালন করছেন প্রায় ২০মণ ওজনের “বাংলার টাইগার” কে। বিশাল এ গরু বিক্রি নিয়ে তিনি মহাবিপাকে পড়েছেন। সঠিক দামে ফ্রিজিয়ান জাতের গরুটি এবার বিক্রি করতে না পারলে তার ব্যবসায়ীক ক্ষতি হবে কয়েক লক্ষ্য টাকা।
জেলা প্রাণি সম্পদ বিভাগের দেওয়া তথ্য মতে, এ বছর ঝিনাইদহ জেলার ৬ উপজেলায় ৭৯ হাজার গরু, ৫শত ৮৯টি মহিষ, ১হাজার ৪শত ২২টি ভেড়া ও ৫৩ হাজার ১শ ২২টি ছাগল কোরবানির জন্য লালন-পালন করা হয়েছে। এসব খামারে প্রস্তুত রয়েছে প্রায় ১৪শ কোটি টাকা মুল্যের এসব কোরবানির পশু। জেলায় কোরবানির চাহিদা রয়েছে ১ লাখ ১৯ হাজার ৪০২টি। জেলায় পশু কোরবানি দেওয়ার পরও প্রায় সাড়ে ১২ হাজারের মত পশু উদবৃত্ত থাকবে। যা দেশের বিভিন্ন জেলায় বিক্রি করা হবে।
আরো জানাযায়, পশু খাবারের দাম বেশি হওয়ায় ঋণ ও ধার দেনা করে খামার করেছেন হাজারো খামারিরা। কোরবানির ঈদকে সামনে করে পশুর বাজার ঠিক থাকবে কিনা এ নিয়ে শংকায় আছেন খামারিরা। বাজার পড়ে গেলে শত শত খামারি পথে বসবে বলে মনে করা হচ্ছে। কোরবানির ঈদের আগে সবারই কম বেশি টার্গেট থাকে। কিন্তু, এ বছর লকডাউনের কারণে কোথাও পশুহাট বসছে না। বাইরে থেকে ক্রেতা বা ব্যপারীরা আসছে না। যার কারণে হাট ইজারা নিয়ে বিপদে আছেন ইজারাদার, ক্রেতা বিক্রেতাসহ সবাই।
বাংলার টাইগারের মালিক আজিজুর ঢাকা পোস্টকে জানান, তার খামারে ফ্রিজিয়ান জাতের (বাংলার টাইগার) গরুটি ছাড়াও আরো চারটি গরু আছে। কিন্তু তিনি ২৬ মাস ধরে (বাংলার টাইগার) কেই কোরবানির ঈদের জন্য প্রস্তুত করেছেন। গত ২৬ ধরে তাকে শুকনা খড়, কাঁচা ঘাষ, খইল, ভূসির পাশাপাশি আলু, আপেল ও আঙ্গুর ফল খাওয়াছেন। গরুটি প্রস্তুত করতে তার খরচ প্রায় ২লক্ষ টাকা। এখন তার বর্তমান ওজন প্রায় ২০ মনের কাছাকাছি। সরকারের দেওয়া বিধিনিষেধ লকডাউনের কারনে কোথাও কোন গরুর বাজার বসছে না। বাড়িতে কিছু ব্যাপারি আসলেও ৩লক্ষ টাকার বেশি কেউ দাম বলেনি। কিন্তু তার গরুটির বর্তমান বাজার মূল্য পায় ৫লক্ষ টাকা। এবারের ঈদে যদি গরুটি ন্যায্য দামে বিক্রয় করতে না পারে তাহলে অনেক ক্ষতিগ্রস্থ হবেন তিনি।
ঝিনাইদহের বাদপুকুর গ্রামের গৃহবধূ শিলা তার রয়েছে বিশাল দুইটি ছাগল। দুই ছাগল নিয়ে তিনি পড়েছেন মহাবিপাকে। দুইটি ছাগাল সর্বোনিম্ন ৪০হাজার টাকা বিক্রয় হলেও তার আসল থাকবে বলে তিনি জানান। কিন্তু সেখানে ৩০হাজার টাকা দামও উঠছে না। তার আশঙ্কা তাদের মতো দরিদ্র পরিবারে এককালীন আয়ের উৎসে শেষ মুহুর্তে কী হবে?
একই এলাকার মহিলা খামারি মোছাঃ লাখি খাতুন ঢাকা পোস্টকে জানান, তার একটি দুগ্ধ খামার আছে। সেখানে তিনি ২২টি গাভি গরু লালন পালন করেন। তা থেকে প্রতিদিন ১৫০ থেকে ২০০ লিটার দুধ পান তিনি। কিন্তু লকটাউনের কারনে তার দুধও বিক্রয় হচ্ছে না।
আরো জানান, তিনি গাভি গরুর পাশাপাশি আলাদা ভাবে ষাড় গরু পালন করছেন। সেখান থেকে একটি ঘাড় গরুকে কোরবানির জন্য প্রস্তুত করেছেন তিনি। যার বর্তমান বয়স ২২ মাস এবং ওজন প্রায় ১৯ মনের কাছা কাছি। লকডাউনের কারনে কোথাও পশু হাট না বসায় তার গরুটি বিক্রয় করতে পরছেন না। এই মুহুর্তে গরুটি বিক্রয় করলে প্রায় ১লক্ষ ৫০হাজার টাকার লোকসান গুনতে হবে তার। সেকারনে তিনি আগামী কোরবানীর ঈদ পর্যন্ত তার গরুটি রেখে দিবেন।
সদর উপজেলার হলিধানী এলাকার খামারি জাহিদুল হক বাবু ঢাকা পোস্টকে জানান, তার খামারে কোরবানির জন্য ৩টি গরু প্রস্তুত করা হয়েছে। যার প্রতিটি গরুর দাম ১লক্ষ ৫০ হাজার থেকে ২লক্ষ টাকার মধ্যে। প্রতি বছরই তার গরু গুলো ঢাকাতে নিয়ে বিক্রি করেন। কিন্তু তিনি চলমান লকডাউনের কারনে ঢাকায় যেতে আশঙ্কাবোধ করছেন। তার মতে এবারে সবখানে গরুর বাজার না বসলে এবং সঠিক ন্যায্য দাম না পেলে পথে বসতে হবে খামারিদের।
গরুর ব্যাপারি মোঃ মধু মোল্লা ঢাকা পোস্টকে জানান, গত কোরবানির ঈদে অনেক গরু ক্রয় করেছিলন। গরুগুলো ঢাকা নিয়ে গিয়ে বিক্রি করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু লকডাউনের কারনে বিক্রয় করতে না পেরে বাড়িতে ফেরত নিয়ে আসেন। সেকারনে অনেক লোকসান গুনতে হয়েছে।
গত বছরের লোকসান এবছর পুষিয়ে উঠতে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে এবছরও ১০ লক্ষ টাকার গরু ক্রয় করেছেন। কিন্তু দেশের কোথাও পশুহাট না বসা এবং ক্রয় বিক্রয় না হওয়ায় আশঙ্কায় আছেন তিনি। এবারো যদি ধরা খায় তাহলে আর কোন উপায় থাকবে, সর্বশান্ত হয়ে হবেন তিনি।
ঝিনাইদহ জেলা প্রাণি সম্পদ কর্মকর্তা ডা: আনন্দ কুমার অধিকারী ঢাকা পোস্টকে বলেন, ঝিনাইদহে প্রায় ১৭ হাজার ৪৫০টি ছোট-বড় খামার রয়েছে। সেখানে কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে ১লক্ষ ৩৩হাজার ৫শত গরু, মহিষ, ভেড়া ও ছাগল প্রস্তুত রয়েছে। সেখানে শুধু জেলায় কোরবানিতে যে পশুর চাহিদা রয়েছে, তা পুরণ করেও প্রায় সাড়ে ১২ হাজারের মত গরু ও ছাগল উদ্বৃত্ত থাকবে। সেইগুলো ঢাকা, সিলেট, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিক্রি হবে। করোনা পরিস্থিতির কারণে একটা অনিশ্চয়তা রয়েছে।
তিনি আরো বলেন, আমরা মাঠ পর্যায়ে পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছি, আশা করা যায় ঈদের আগে খামারিরা এবং বাজারের ইজারাদারেরা যাতে বাজার ধরতে পারে সে বিষয়ে প্রাণি সম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে কার্যকর সিদ্ধান্ত আসবে।