‘শাকিবের সঙ্গে আমার যে কতটা আন্তরিক সম্পর্ক মানুষ তা জানে না’

Share Now..

ঢাকায় হযরত শাহজালাল বিমানবন্দরের লাউঞ্জে বসে যখন অপেক্ষা করছি ফ্লাইটের। তখন বারবার চঞ্চল চৌধুরীর ফোন। ‘তানভীর ভাই। আপনি কী কনফার্ম, আজকের ফ্লাইট ছাড়বে? ছাড়লেও ট্রানজিট ফ্লাইট কী ঠিক থাকবে? একটু খোঁজ নিয়ে জানাবেন প্লিজ। কনফার্ম না হয়ে যাইয়েন না প্লিজ।’

১৮ এপ্রিলের রাত। এমিরেটস এর আগে-পরের ফ্লাইটে আমার ও চঞ্চল চৌধুরীর যাওয়ার কথা নিউইয়র্ক। সেখানে সুচিত্রা সেন ফেস্টিভ্যাল ২০ ও ২১ এপ্রিল। এদিকে আকস্মিক ভারী বৃষ্টি বন্যায় দুবাই শহর তলিয়ে গেছে। আমাদের ফ্লাইটটি যেহেতু দুবাই ট্রানজিট হয়ে যাবে। তাই বিপদ-শঙ্কা টা এখানেই। 

এয়ার এশিয়ার আশিকুর রহমান ও বিমান বাংলাদেশের ইউসুফ ইকরাম পুলক দুজনই আমাকে আপডেট জানাচ্ছেন। ফ্লাইট দুবাইয়ের উদ্দেশে যাবে কী না। গেলে কতটা বিলম্ব হতে পারে। আমিও সেই অনুযায়ী চঞ্চলকে আপডেট জানিয়ে যাচ্ছি। 

চঞ্চল চৌধুরীর যেহেতু পরের ফ্লাইট তাই আমার আপডেট শুনে তবেই তিনি রওনা হবেন বলে মনস্থির করেছেন। হঠাৎ করেই নিউইয়র্কের এই অনুষ্ঠানে যাওয়া সিদ্ধান্ত আমার।

এদিকে যাওয়ার পথেই এমন বিপদসংকুল অবস্থাকে আরও সংকটময় করে তুলল উপস্থাপক অভিনেতা শাহরিয়ার নাজিম জয়ের অডিও বার্তা। জয় ফোন করে জানালো, কোনোভাবেই যেন আমি ও চঞ্চল ভাই ফ্লাইটে না উঠি। উঠলেই দুবাইতে আটকা পড়ে যাবো। ভয়াবহ বিপদে পড়ে যাবেন! আমি আমার স্ত্রীসহ মহাবিপদে। আরেকটু পর ফোনও করতে পারবো না!’

আমার ও চঞ্চল চৌধুরীর তখন কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থা। এয়ার লাইন তাদের লাস্ট চেকিং শুরু করেছে। লাইনে দাঁড়িয়ে। চেকিং শেষ করে দাঁড়িয়ে আছি দীর্ঘক্ষণ! কারণ বসার জায়গা নেই! সবার মনেই শঙ্কা। প্রায় ৪ ঘণ্টা দাঁড় করিয়ে রেখে জানানো হলো ফ্লাইট বাতিল। বাসায় ফিরতে হলো ভোর ৫ টায়। জানলাম চঞ্চল চৌধুরীও এয়ারপোর্টে এসে আবার ফিরে গেছেন। 

পরদিন আয়োজক কুয়েত এয়ারওয়েজের ওয়ান ওয়ে ফ্লাইট ঠিক করলেন। যেখানে আমি ও চঞ্চল চৌধুরী এবার একই ফ্লাইটে। দীর্ঘ যাত্রায় নানান আলাপ শুরু হলো আমাদের। কুয়েত এয়ারওয়েজের ট্রানজিট মাত্র ১ ঘণ্টাসহ টানা ২২ ঘণ্টার প্লেন জার্নি। আমি চঞ্চল চৌধুরী একসঙ্গে। চঞ্চল চৌধুরী কালো মাস্ক পরে আছেন। তারপরও তার ভক্তকুল এসে বলছেন, ‘মাস্ক খুলুন। আমি আপনাকে চিনে ফেলেছি। আপনার অভিনীত ‘রুমী’ দেখেছি। দারুণ লেগেছে। অতঃপর ছবি, সেলফি এসবই চলছে।

চঞ্চল ভাই কেমন লাগে? এই খ্যাতির জীবন? চঞ্চল বলেন, ‘মন্দ লাগার তো কথা না। কিন্তু ইদানিং খানিক অস্বস্তিতে ভুগি। এই ফেসবুকের যুগে সবাই তো প্রতিক্রিয়া জানাতে অভ্যস্ত। তারা আমাদের যেকোনো কিছুকে নিয়ে বিচার শুরু করে দেয়। যা আগে ছিল না।’

কথায় কথা বাড়ে। গেল ঈদে চঞ্চল চৌধুরীর দুটি প্রডাকশন প্রকাশ পেয়েছে। ভিকী জাহেদের রুমী ও মোস্তফা সরয়ার ফারুকির ‘মনোগামী।’ দুটি নিয়ে জানতে চাইলে চঞ্চল বললেন, ‘কাজ যেহেতু কমিয়ে দিয়েছি। তাই এখন আমি নিজের কাজ করার পর কোনোরকম অস্বস্তিতে ভুগি না। একটা সময় বিভিন্ন মানের কাজ করতাম। কিন্তু নিজের কাজ ও ক্যারিয়ারের ব্যাপারে আরও বাছবিচার রাখবো বলেই একদম কোনোরকম অ্যাভারেজ কাজও করিনা। তাতে আমার আর্থিক ক্ষতি হয় ঠিকই। কিন্তু আমার দর্শকের জন্য এটি আমার নিজস্ব কমিটমেন্ট রাখার চেষ্টা করি।’

উড়োজাহাজ তখন ৩৬ হাজার ফুট ওপরের আকাশে। ফ্লাইটের নিজস্ব ওয়াইফাই কিনে আপডেট দেখতেই চোখে পড়ে চঞ্চল চৌধুরী ভিলেন হচ্ছেন? এমন খবর! ভিলেনের পাশে বসে আছি, অথচ ভিলেনটা আমাকে জানালোই না! 

চঞ্চলকে ওর দিকে তাকিয়ে রাগ নিয়ে জিজ্ঞেস করি। কী ব্যাপার গতকাল থেকে এতবার কথা হচ্ছে। অথচ এমন একটা খবর আমার কাছে লুকালেন? দেখলাম চঞ্চলও ভ্রু কুঁচকে বললেন। কী বলেন তানভীর ভাই। আমি কী লুকালাম?’ 

-এই যে। আপনি রায়হান রাফি’র তুফানে শাকিব খানের সঙ্গে ভিলেন হিসেবে পর্দায় হাজির হচ্ছেন? চঞ্চল তার চিরচেনা হাসি দিয়ে বললেন। এই খবর আমিও তো কনফার্ম না। একটা মৌখিক কথা হয়েছিল। দেখেন অনলাইন ইউটিউবের কী অবস্থা! আমি নিজেই কনফার্ম করিনি। অথচ সবাই গল্প বানিয়ে বসে আছে। কাজটা হবে কী না, এটা এখনও চূড়ান্ত আমিও জানি না। কিন্তু চলচ্চিত্রে বিশেষ ক্যামিও যদি করেই থাকেন। তাহলে তা এভাবে জানাজানি হওয়াটা কী ক্ষতিকর না?

চঞ্চল বললেন, ‘আমারও সেই একই কথা। দেখুন পাঠান বা টাইগার থ্রি’তে শাহরুখ, সালমানরা যে ক্যামিও করেছে। সেই খবর কী লিক হয়েছে? কারণ তারা তাদের জায়গা ভীষণ কমিটেড। অথচ এই খবর আমার আগে বাইরের মানুষ জানে। তাহলে এক্সক্লুসিভ ব্যাপারটা থাকলো কই বলেন?

আমরা তখন ট্রানজিটে। চঞ্চলের ভিলেন হওয়ার খবরে সয়লাব সোশ্যাল মিডিয়া। চঞ্চল সেগুলো দেখছেন আর হাসছেন। বললেন,‘রাফির সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। কাজটা হতেও পারে। কিন্তু চূড়ান্ত না। এমনকি শাকিবের সঙ্গে আমার যে কতটা আন্তরিক সম্পর্ক মানুষ তা জানে না। আমরা বাইরে থেকে জাজ করে ফেলি! এটা কী আপনাদের ক্ষতি করে?

দেখুন লাভ ক্ষতি তো থাকেই। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো। আপনি এক ধরনের মানসিক অস্বস্তিতে পড়বেন। এটা কিন্তু বাংলাদেশে প্রকট আকার ধারণ করছে। ভারতেও কিছুটা। অরিজিৎ সিং আমার খুব প্রিয় শিল্পী। কিন্তু দেখবেন সোশ্যাল হ্যান্ডেলে ওর ফ্যানরা গ্রুপ খুলে বসে আছে, ‘নাম্বার ওয়ান অরিজিৎ’ নামে। তাহলে কী অন্যদের আপনি হেয় করছেন না। 

‘একজনকে ভালোবাসা বা তার ফ্যান হওয়া মানে এই নয় যে, অন্ধ ভালোবাসা দিয়ে আপনি অন্যকে ঘায়েল করে মজা নেবেন। এই চর্চা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। আমি মনে করি ফ্যান ম্যানেজমেন্টটাও দেখা উচিত।’ আমাদের দীর্ঘ পথের যাত্রা। দুজনই বিগত ৩০ ঘণ্টা ঘুমাইনি। কেবিন ক্রুরা খাবার দিয়ে গেছে। খেয়ে কিছুটা বিশ্রাম নেওয়ার চেষ্টা করবো।

মাত্র ক’মাস আগে চঞ্চল আপনি একটি অনলাইন পত্রিকার ইন্টারভিউতে বলেছিলেন, কমার্শিয়াল মুভি অর্থাৎ ঢিসুম ঢিসুম মারপিট আর নাচ গানের মুভির আয় নিয়ে আলোচনাটা অনর্থক। অথচ রাফির প্রজেক্টটা কনফার্ম হলে-আপনি শাকিবের সেই ঘরানার ছবিতেই বিশেষ ক্যামিও দিতে যাবেন। তাহলে কী নিজের চিন্তার জায়গা থেকে সরে আসলেন কিছুটা?

চঞ্চল চৌধুরী বললেন, ‘না দেখুন সরে আসবো কেন। আমি যে ঘরানার মুভি করেছি। সেই ঘরানা হয়নি জীবনের আশপাশের গল্পের সমান্তরাল। একেকজন একেকভাবে ছবির গল্প বলেন। আমরা অভিনেতা কাজটা করে যাই। আমার আপত্তির জায়গা ছিল একটা ছবি কত লক্ষ কোটি বিজনেস করলো, তা একজন দর্শকের বা ফ্যান ফলোয়ারদের আলোচ্য হতে পারে না। আমরা আলোচনা করবো, ছবির গল্প, এর নির্মাণ শৈলি নিয়ে।’

কথায় কথায় আমরা উড়ে উড়ে বহুদূর। কুয়েত এয়ারওয়েজের প্লেনের ফ্রন্ট ব্যাক ক্যামেরায় বারবার চঞ্চল দেখছেন মেঘের ভেতর দিয়ে কীভাবে উড়ে চলছে এই বিশাল যানটি। যেভাবে নিজের ক্যারিয়ারেও নানান গল্পে, নানান নির্মাতার চোখ দিয়ে উড়ে চলেছেন তিনি। আমরা দুজন তখন প্রশান্ত মহাসাগর পাড়ি দিচ্ছি!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *