২০ লাখ জনসংখ্যার দেশের স্বর্ণ জয় 

Share Now..

মিক্সড জোনে সাংবাদিকদের ভিড়। বড় একটা অংশ যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাথলেটদের সঙ্গে কথা বলার অপেক্ষায়। আছেন ইংল্যান্ড, হল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়ার সাংবাদিকরা। পা ফেলার জায়গা নেই। কিন্তু বৎসোয়ানা দেশের কোনো সাংবাদিক নেই। মিক্সড জোনের স্বেচ্ছাসেবকরা খুঁজছেন বৎসোয়ানার কোনো সাংবাদিক রয়েছেন কিনা। স্বেচ্ছাসেবক তরুণী ইত্তেফাকের সাংবাদিকের গায়ের রং দেখে জিজ্ঞাসা করলেন আপনি কোন দেশের? এখানে বৎসোয়ানা থেকে কেউ আসেননি? নাইজেরিয়ার সাংবাদিক চার-পাঁচ জন আওয়াজ তুললেন, ‘আমরা তেবথো লেসিলের সঙ্গে কথা বলব।’   

স্বেচ্ছাসেবক তরুণী বললেন, ‘একজন সাংবাদিকও কি আসেননি বৎসোয়না থেকে। ওকে আপনারা ওখানে গিয়ে দাঁড়ান।’ নিয়ম অনুযায়ী পদক পাওয়া ক্রীড়াবিদ প্রথমে তার দেশের সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলবেন, পরে অন্যান্য দেশের সঙ্গে কথা বলবেন। কিন্তু ২০০ মিটার স্প্রিন্টে যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে স্বর্ণজয়ী তেবখো লেখিলের দেশ বৎসোয়ানা থেকে কোনো সাংবাদিক না আসায় নাইজেরিয়ান সাংবাদিকরাই বৎসোয়ানার সাংবাদিক হয়ে গেলেন। দূর থেকে দাঁড়িয়ে দেখছেন যুক্তরাষ্ট্রের সাংবাদিকরা। তারা স্বর্ণপদক জয়ী নতুন তারকার সঙ্গে কথা বলারও প্রয়োজনটা মনে করলেন না কেন, বোঝা গেল না। বৎসোয়ানা দেশের এক অ্যাথলেট মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে হারিয়ে দিয়েছেন। আফ্রিকার দক্ষিণ অঞ্চলের ২০ লাখ জনসংখ্যার দেশ বৎসোয়ানার অ্যাথলেট তেবখো লেমিলে জয় করেছেন ২০০ মিটার স্প্রিন্টের স্বর্ণ। এই দেশের কোনো ক্রীড়াবিদ এই প্রথম অলিম্পিকে স্বর্ণ জয় করেছেন। শুধু তা-ই নয়, দক্ষিণ আফ্রিকা অঞ্চলে কোনো ক্রীড়াবিদ অলিম্পিক গেমসের ২০০ মিটার ইভেন্টে স্বর্ণ জয় করেনি। এটাও আফ্রিকান অঞ্চলের জন্য ইতিহাস। বৎসোয়ানার রাজপুত্র আসলেন খালি পায়ে। গলায় কমলা রঙের বুট জোড়া ঝুলিয়ে রেখেছেন। এই বুট পায়ে স্তাদে দ্য ফ্রান্সের বেগুনি রঙের স্লিকে দৌড়েছেন তেবছো লেসিলে। বুটে লেখা রয়েছে ২৩-১২-১৯৮০, এটি তার মায়ের জন্ম তারিখ। 

ইত্তেফাকের প্রশ্নে জবাব দিয়েছেন তেবখো লেসিলে। জানালেন তার মা মারা গেছেন গেল মে মাসে।’ কোনো রোগে শোকে মারা গেছেন কি না জানতে চাইলে ইত্তেফাককে তেবখো বললেন, ‘ক্যানসার হয়েছিল।’ বাবা সম্পর্কে জানতে চাইলে কিছুই বলেননি। বৎসোয়ানার মিডিয়া এটাচি তেবখো লেসিলের বাবা সম্পর্কে কিছুই বললেন না। শুধু বললেন, ‘বাবা নেই বাবার কথা কেউ জানে না। আমরাও জানি না। মা ছিল মারা গেছেন। আর বোন আছেন একজন।’ সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হচ্ছে তিন মাসও হয়নি মা মারা গেছেন। এর মধ্যেও শোক বুকে নিয়ে পৃথিবী জয় করেছেন বৎসোয়ানার ছেলে তেবখো লেসিলে। মায়ের মৃত্যু শোকের কথাটা তুললে খুব সহজভাবে স্বর্ণজয়ী তেৰখো লেসিলে বললেন, ‘মায়ের শোক মনে রাখলে আপনি অলিম্পিকে লড়াই করতে পারবেন না। মৃত্যু শোক আমাকে কাঁদায়। আমি যদি কাঁদি তাহলে আমাকে স্টেডিয়ামের বাইরে থাকতে হবে। পৃথিবী আমাকে দেখতে পারবে না। শোকটাকে চাপা দিয়ে আরও ভালো করে অনুশীলন করেছি। আপিনও কথা বলতে এসেছেন।’ তবে এটাও ঠিক যে আমার মা যখন মারা যান তখন অনেকেই ধরে নিয়েছিলেন আমার কারিয়ার শেষ। আজ যদি আমার মা বেঁচে থাকতেন তাহলে তিনিই সবচেয়ে বেশি খুশি হতে পারতেন। আমার মা আমার ওপর আস্থা রাখতেন। আমি নিজেও আমার ওপর এতটা আস্থা রাখতে পারতাম না’-বললেন তেবখো লেসিলে। 

২০০ মিটার স্প্রিন্টে তেবখো লেসিলে হারিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের তিন অ্যাথলেটকে। তেবখো লেসিলের টাইমিং ছিল ১৯.৪৬ সেকেন্ড, যুক্তরাষ্ট্রের রৌপ্য জয়ী কেনথ বেডনারেক ১৯.৬২ সেকেন্ড, ব্রোঞ্জ জয়ী নেয়া লাইলস ১৯.৭০ সেকেন্ড সময় নিয়েছেন। বেগুনি ট্র্যাকে ২০০ মিটার স্প্রিন্ট শুরু হওয়ার পরই বাঁক খানো মোড়ে এসে এগিয়ে যান ১০০ মিটারের ট্র্যাকে এসে সবার চোখে ঢুকে পড়েন তেবখো লেসিলে। বাঁক খানো মোড়েই আসল চমকটা দেখিয়েছেন এই অ্যাথলেট। সবচেয়ে বড় কথা কী ২০০ মিটারের সেমিফাইনালেও তেবখো লেসিলে প্রথম হয়েছিলেন। সেখানেও যুক্তরাষ্ট্রের নোয়া লাইলস পেরে ওঠেননি স্বর্ণ জয়ী তেবখো লেসিলে সংবাদ সম্মেলনে সবাইকে থমকে দিয়েছেন। 

অলিম্পিকে স্বর্ণ জেতা একজন ক্রীড়াবিদ দুর্দান্ত ফুরফুরে থাকার কথা। তার ভেতরে এতটুকু হাসি আনন্দ দেখা যায়নি। তেবখো লেসিলকে ‘স্বপ্ন সত্যি হয়েছে’ একথা বলার পর পালটা প্রশ্ন করেন তেবখো লেসিলে, ‘স্বপ্নপূরণ হওয়ার কী আছে।’ অলিম্পিকে স্বর্ণ জয় করা কী স্বপ্নপূরণ নয়? কথাটার আমলই দিলেন না তেবখো লেসিলে। এই প্রশ্নটি আরও ক্লিয়ার করার জন্য ইত্তেফাকের সাংবাদিক তেবখো লেসিলকে পুনরায় প্রশ্ন করলেন স্বপ্নপূরণ হওয়ার কী আছে- কথাটার মানে কী। তখন তিনি বলেন, ‘আমি তো স্বপ্নপূরণ হওয়ার কিছু দেখছি না। আমার টার্গেট হচ্ছে ২০২৮ অলিম্পিক গেমস। ২০২০ অলিম্পিকের পর আমি প্যারিসে এসে দেখলাম সঠিক জায়গায় আমি এসেছি কিনা। আমার প্রশিক্ষণ কেমন হয়েছে। সামনে আমাকে আর কী কী করতে হবে। স্বর্ণ পদক যেটা পেয়েছি এটা হচ্ছে, বোনাস’ বললেন তেবখো লেসিলে। 

এই স্বর্ণজয়ী যোগ করলেন, ‘আমি প্যারিসে এসেছি অভিজ্ঞতা অর্জন করতে। আমি এখন পর্যন্ত যতগুলো সাক্ষাৎকার দিয়েছি কোথাও বলিনি পদক জিততে চাই। আমি চাইনি আমার ওপর চাপ আসুক। এ কারণে বলছি আমি অভিজ্ঞতা অর্জন করতে এসেছি পদক জিততে নয়। যেটা পেয়েছি সেটা বোনাস। স্বর্ণ জয় এটা তো অনেক বড় ব্যাপার-আমার কাছে বিগ ডিল না। আমার জাদু তো এখনো দেখেনই নাই।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *