যশোরে চালের দাম বাড়ছেই, টিকে থাকা নিয়ে শঙ্কিত সাধারণ মানুষ

Share Now..

\ যশোর জেলা প্রতিনিধি \
সরকার দেশের বাজারে চালের দাম নিয়ন্ত্রণে ভারত ও সর্বশেষ মিয়ানমার থেকে শুল্কমুক্ত চাল আমদানি করেছে। সেই সাথে চলছে ধানকাটার ভরা মৌসুম। কিন্তু যশোরের বাজারে তার কোনো প্রভাব পড়েনি। উল্টো ৬৭ টাকা কেজির বাংলামতি (বাঁশমতি নামে বিক্রি) চালের কেজি ঠেকেছে ৮৮ থেকে ৯৩ টাকায়। কথিত মিনিকেট চাল ৬০-৬২ থেকে বেড়ে হয়েছে ৭০-৭২ টাকা। মোটা চালের দামেও কেজিতে বেড়েছে ২-৫ টাকা। যশোর বড়বাজার নামে পরিচিত হাটচান্নি ও চুড়িপট্টি এলাকার চালের খুচরা বিক্রেতারা বলছেন চালের দাম বাড়তি। কেন তা জানা নেই এসব খুচরা ব্যবসায়ীদের। এই জানা না জানার ফাঁদে পড়ে চরম বিপাকে পড়েছেন নিন্মমধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ। যারা সরু চাল কিনতেন, এখন তারা কিনছেন মোটা চাল। যশোরের ব্যবসায়ীরা জানান-ভারত থেকে বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে এক মাসে শুল্কমুক্ত সুবিধায় সাড়ে ৪ হাজার টন চাল আমদানি করা হলেও বাজারে এর কোনো প্রভাব পড়েনি। দাম কমার পরিবর্তে প্রতিদিনই দাম বাড়ছে। জানা যায়, ১৭ নভেম্বর থেকে ১৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে সাড়ে ৪ হাজার টন চাল আমদানি হয়েছে। যদিও অনুমোদন দেয়া হয় ৩ লাখ ৯২ হাজার টন চাল আমদানির। মিয়ানমার থেকে সরকারিভাবে আমদানি করা ২২ হাজার টন আতপ চাল নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে ভিড়েছে ‘এমভি গোল্ডেন স্টার’। শুক্রবার (১৭ জানুয়ারি) বেলা সাড়ে ১২টার দিকে জাহাজটি বন্দরের ৯ নম্বর জেটিতে ভেড়ে। চট্টগ্রাম খাদ্য অধিদপ্তরের চলাচল ও সংরক্ষণ নিয়ন্ত্রক জ্ঞানপ্রিয় বিদূর্শী চাকমা বলেন, জাহাজটি এসেছে মিয়ানমারের ইয়াঙ্গুন থেকে। বিকাল ৫টা থেকে চাল খালাস শুরু হয়। কিন্তু আশার আলো দেখতে পাচ্ছেন না ভোক্তা। বেনাপোল চেকপোস্ট কার্গো শাখার রাজস্ব কর্মকর্তা আবু তাহের জানান, গত ১৭ নভেম্বর থেকে ১৭ ডিসেম্বর ভারত থেকে শুল্কমুক্ত চাল আমদানি করা হয়। মাহবুবুল আলম ফুড প্রডাক্টস, অর্ক ট্রেডিং, সর্দার এন্টারপ্রাইজসহ আট আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান এ বন্দর দিয়ে এসব চাল আমদানি করেছে। এর আগে বেসরকারিভাবে ৯২টি প্রতিষ্ঠানকে ২ লাখ ৭৩ হাজার টন সেদ্ধ চাল ও ১ লাখ ১৯ হাজার টন আতপ চাল আমদানির অনুমতি দেয়া হয়। আমদানীকৃত চাল বাজারজাত করার জন্য মাত্র ২৫ দিন সময় নির্ধারণ করে দেয় সরকার। এ স্বল্প সময়ের মধ্যে অনেক প্রতিষ্ঠান আমদানি করতে পারেনি। তাই পরবর্তী সময়ে ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত সময় বৃদ্ধি করে সরকার। যশোরের চাল আমদানিকারক মাহবুব আলম বলেন, ‘ধীরগতিতে চাল আমদানি হয়েছে। সরকার ৩ লাখ ৯২ হাজার টন চাল আমদানির প্রথমে ১৭ নভেম্বর থেকে ১২ ডিসেম্বর পর্যন্ত মাত্র ২৩ দিন সময় বেঁধে দেয়। পরে ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত সময় বাড়ানো হয়। তবে পর্যাপ্ত পরিমাণে চাল আমদানি করা গেলে শিগগিরই হয়তো চালের দাম কমে আসবে। কিন্তু তার সেই ধারণা বাস্তবে দেখা যায়নি। এদিকে চলতি মৌসুমে ধানের দাম বেশি, যে কারণে কমছে না চালের দাম—এমনটাই দাবি করছেন অটো রাইস মিল মালিক ও ধান ব্যবসায়ীরা। আমদানিকারকদের মতে, ভারতেও চালের দাম বেশি। এ কারণে আমদানীকৃত চাল কম দামে বাজারে বিক্রি করা সম্ভব হচ্ছে না। যশোর সীমান্তবর্তী অঞ্চলে বেশির ভাগ ধান উৎপাদন হয়। চলতি মৌসুমে এ অঞ্চলে ২১ হাজার ৪৭০ হেক্টর জমিতে আমন চাষ হয়, যা মণপ্রতি ১৩৫০-১৪৫০ টাকায় বিক্রি করছেন কৃষক। যশোরের ইলা অটো রাইস মিলের মালিক শরিফুল ইসলাম বলেন, ‘এখনো ধান কিনতে পারেননি বেশির ভাগ মিল মালিক। কোনো কোনো মিল মালিক অন্য জেলা থেকে ৩২-৩৪ টাকা কেজি দরে ধান কিনছেন। এসব ধান থেকে চাল প্রস্তুত করতে দাম পড়ছে ৫২ টাকা।’ শহরের বড় বাজারের পাইকারি ব্যবসায়ী আশিষ দে জানান, বাজারে মোটা চাল ৫২ টাকা, হীরা ৪৮, ঊনপঞ্চাশ ৫৬, আঠাশ ৫৮-৬০, মিনিকেট ৬৪-৬৮, তেষট্টি ৬৮-৭০, বাসমতী ৮০-৮৬ এবং নাজিরশাইল ৮০ টাকা কেজি দরে পাইকারি বিক্রি হচ্ছে। আর খুচরা বাজারে সব ধরনের চাল বিক্রি হচ্ছে ২-৩ টাকা বেশিতে। কিন্তু তার বলা এই দামের সাথে বাজারে খুচরা দামের মিল খুঁজে পাওয়া যায়নি। সরু চালের দাম আরও বেশি দামে বিক্রি করতে দেখা গেছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, আমদানি করা মোটা চাল বন্দর থেকে পাইকারি বিক্রি হচ্ছে কেজিপ্রতি ৫২-৫৩ টাকায়। ওই চাল পাইকাররা ৫৪ টাকায় বিক্রি করছেন। আর খুচরা বিক্রি হচ্ছে ৫৬ টাকায়। বেনাপোল কাস্টম হাউজের অতিরিক্ত কমিশনার এইচএম শরিফুল হাসান বলেন, ‘শুল্কমুক্ত সুবিধায় বেনাপোল বন্দরে টনপ্রতি ৪১০ ডলারে চাল আমদানি হচ্ছে। ১৭ নভেম্বর থেকে ১৭ ডিসেম্বর এক মাসে ৪ হাজার ৫০০ টন চাল আমদানি হয়। কাস্টমসের সব কার্যক্রম দ্রæততার সঙ্গে সম্পন্ন করা হয়। তবে বাজারে এর প্রভাব পড়ে কি-না, তা বলতে পারবো না। শুক্রবার (১৭ জানুয়ারি) বড়বাজার ঘুরে দেখা গেছে-সরু চাল অর্থাৎ বাংলামতির কেজি ৯৩ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। খুচরা বিক্রেতারা বলছেন-এতো এতো চাল আমদানি, সেই সাথে দেশিয় চাল বাজারে আসছে কিন্তু কেন দাম বাড়ছে তা জানা নেই। বেশ কয়েকটি ছাত্র-ছাত্রী মেস থেকে আসা কয়েকজন শিক্ষার্থীর সাথে কথা হয় সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদকের। তারা জানান-মেসে সব সময় মোটা চাল কিনতে হয়, খরচ কমাতে কিন্তু গত ৪ মাসে প্রতিকেজি মোটা চালে ২ থেকে ৯ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। যেকারণে মেস খরচ বেড়ে গেছে। রজব আলী নামের এক স্কুল শিক্ষক জানান-সরু চালের ভাত খাওয়ার অভ্যাস গড়েছে উঠেছে বাচ্চাদের কিন্তু এখন বাধ্য হয়ে মোটা চাল কিনে বাঁচার চেষ্টা করতে হচ্ছে। তিনি বলেন-একমাত্র সবজিতে স্বস্তি ফিরেছে। বাকি সব পণ্যের লাগাম ছাড়া। তিনি বলেন নিন্মবিত্ত ও সীমিত আয়ের মানুষের টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়েছে। এ বিষয় নিয়ে জানতে চাইলে প্রবীণ এক রাজনীতিক বলেন-দেশের সব সেক্টরে অস্থিরতা বিরাজ করছে। কোথাও মনিটরিং নেই। তাছাড়া প্রশাসনের কথা শুনছে না ব্যবসায়ীরা। এর মধ্যে সরকার অযৌক্তিকভাবে ভ্যাট-ট্যাক্স বাড়িয়ে আগুনে ঘি ঢেলে দিয়েছে। অধিক মুনাফাখোর ব্যবসায়ীরা সিÐিকেট করে সব পণ্য বেশি দামে বিক্রি করছে। এনিয়ে খুচরা বিক্রেতাদের নানা প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। ক্রেতারা এখন দিশেহারা। সহসাই বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকার সফল হবে-এমন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। তিনি আরও বলেন-এ অবস্থা শুধু যশোরে না, দেশজুড়ে দামের পাগলা ঘোড়া ছুটছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *