ফেসবুকের কল্যানে লড়াকু এক জাহেদার ৩৫ বছর পর ঘরে ফেরার গল্প

Share Now..


আসিফ কাজল, ঝিনাইদহঃ
ফেসবুকের কল্যানে ৩৫ বছর পর নিজ বাড়িতে, তারপরও থাকতে পারছেন না মায়ের কাছে। ফিরে যেতে হবে আবার পাকিস্থানে। সেখানে তার সংসার আছে, আছে স্বামী-সন্তান। বাড়ি ফিরে গ্রামের সেই চেনা মেঠা পথ আর প্রিয় মানুষগুলো জাহেদার কাছে বড্ডো অপরিচিত লাগে। তারপরও শান্তি তিনি মায়ের মুখ দেকতে পেরেছেন। ঝিনাইদহ পৌরসভা এলাকার জব্বার আলী শেখের বড় কন্যা জাহেদা খাতুন। এক সময় বাংলাদেশে স্বামী সংসার সবই ছিল তার। কিন্তু সতিনের চক্রান্তে নারী পাচারকারীদের হাত বদলাতে বদলাতে আশ্রয় পান পাকিস্থানে। সেখানেই থিতু হন তিনি। পাকিস্থানী যুবকের সঙ্গে নতুন করে সংসার পাতেন জাহেদা। ৩৫ বছর পর ফেসবুকের কল্যানে জাহেদা ফিরে আসেন বাপের পুরানো ভিটেই। সাক্ষাত পান মা, বোন, ভাই ও পাড়া প্রতিবেশিদের সাথে। শুনতে রুপকথার গল্পের মতো মনে হলেও ঝিনাইদহের সেই জাহেদার এক লড়াকু জীবন। প্রতিকুল পরিবেশ মানিয়ে বারবার যুদ্ধ করেছেন জীবনের সঙ্গে। বাঁচার জন্য তিনি লড়ে গেছেন জাহেদা। ২০ বছর বয়সে তিনি পাকিস্থানে পাচার হয়েছিলেন। এখন তার বয়স ৫৫ বছর। ১৯৮০ সালে ২০ বছর বয়সে পাবনা জেলার ঈশ্বরদী গ্রামের আব্দুর রহিমের সঙ্গে বিয়ে হয় জাহেদা খাতুনের। রহিমের আরও একটি স্ত্রী ছিল। সতিনের ঘর। বিবাদ লেগেই থাকত। বিয়ের ৫ বছর পর শ্বশুরবাড়ির লোকজন নেশাজাতীয় ওষুধ খাইয়ে নারী পাচারকারী চক্রের কাছে বিক্রি করে দেয় জাহেদা খাতুনকে। গোপন থেকে যায় সেই খবর। অনেক খোঁজাখুঁজির পরও তাকে না পেয়ে পরিবারের লোকজন ভেবেছিল মারা গেছেন তিনি। অবশেষে গত ২৯ আগষ্ট সবাইকে চমকিয়ে বাড়ি পেরেন জাহেদা। এই ফিরে আসার গল্প অনেক লম্বা। বাংলাভাষা ভুলে গেছেন জাহেদা। উর্দু ভাষাায় জাহেদা জানান, নারী পাচারকারীরা পাকিস্তানের করাচি শহরে নিয়ে যায় তাকে। সেখানেও তাকে দুই দফায় বিক্রি করা হয়। সব শেষ এক মৌলভী সাহেব কিনে নেন তাকে। ঠাঁই হয় পাকিস্তানের একটি মাদ্রাসায়। ভাগ্য ভালো জাহেদা। ওই মাদ্রাসার মৌলভী সাহেব এক পাকিস্তানী যুবক গুল্লা খানের সঙ্গে বিয়ে দেন। দুই সন্তানের মা হন জাহেদা। ছেলে মারা গেছেন। একমাত্র মেয়ে ইয়াসমিন (২২) ও পাকিস্তানি স্বামীকে নিয়ে এখন সংসার তার। মেয়ের বিয়ে হয়েছে। কিন্তু কীভাবে ফিরলেন এমন প্রশ্নের জবাবে জাহেদা বলেন, ২০১৮ সালের দিকে পাকিস্তানী যুবক ওয়ালিউল্লাহ মারুফের কাছে জীবনের করুন কাহিনী তুলে ধরেন জাহেদা। ফেসবুক পেজে জাহেদাকে নিয়ে ভিডিওসহ উর্দুতে পোস্ট করেন যুবক ওয়ালিউল্লাহ মারুফ। তার দেওয়া পোস্ট চোখে পড়ে নেত্রকোনা জেলার ছেলে মনজুর আহমেদের। তিনি সেটি বাংলায় অনুবাদ করেন। এরপর শুরু হয় জাহেদার শিকড়ের সন্ধান। মনজুর আহমেদ ছুটে আসেন ঝিনাইদহের ভুটিয়ারগাতী গ্রামে। সেখানেই পেয়ে যান জাহেদার মা-বাবার পরিচয়। ফেসবুকে যোগাযোগ করেন পাকিস্তানের ওই যুবকের সঙ্গে। তার মাধ্যমে মায়ের সঙ্গে কথা হয় জাহেদার। মায়ের সঙ্গে কথা বলার পর দেশে ফিরে আসার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠেন তিনি। টাকা ও পাসপোর্টের অভাবে ফিরতে পারছিলেন না জাহেদা খাতুন। পাকিস্তানের যুবক ওয়ালিউল্লাহ মারুফ সব ব্যবস্থা করে দেন। অবশেষে গত ২৮ আগস্ট দুরু দুরু মন আর স্বজনদের সঙ্গে মিলিত হওয়া উচ্ছাস বুকে নিয়ে প্লেনে চেপে বসেন জাহেদা। নেত্রকোনার যুবক মনজুর আহমেদ বিমানবন্দর থেকে জাহেদাকে নিয়ে ঝিনাইদহে ফেরেন। ৩৫ বছর হারিয়ে যাওয়া জাহেদা ফিরে আসার খবর ছড়িয়ে পড়লে গ্রামের মানুষ, আত্মীয় স্বজন সবাই ছুটে আসেন জাহেদাকে দেখতে। জাহেদা জানান, মাত্র ৩ মাসের ভিসা নিয়ে এসেছেন বাংলাদেশে। বিষয়টি নিয়ে ঝিনাইদহ পৌরসভার মেয়র সাইদুল করিম মিন্টু বলেন, দীর্ঘ ৩৫ বছর পর জাহেদা তার বাবার বাড়ি ফিরে আসায় তিনি খুব খুশি হয়েছেন। তাকে ফিরিয়ে আনতে যারা কাজ কাজ করেছেন, তাদের প্রতি তিনি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। একইসঙ্গে পাচারের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের দৃষ্টান্তমূলক বিচার দাবি করেন তিনি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *