বিজয় দিবসকে ঘিরে ৬ দিনে ২০ কোটি টাকার ফুল বিক্রয়

Share Now..

\ ঝিনাইদহ অফিস \
হঠাৎ ফুলের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় স্বস্তি ফিরেছে ফুল চাষী ও ব্যবসায়ীদের মাঝে। ঝিনাইদহের অন্যতম লাভজনক চাষ ফুল। যা ঝিনাইদহ জেলা থেকে বছরে প্রাই দুইশ কোটি টাকার উপরে বিক্রয় হয়ে থাকে। চলতি বছরে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে দেশব্যাপী দফায়-দফায় হরতাল অবরোধের কারণে ফুল চাষীরা হতাশাগ্রস্থ হয়ে পড়েছিলেন। একদিকে ফুলের চাহিদা যেমন কমেছিল, অন্যদিকে পরিবহন খরচে দ্বিগুন হওয়ায় পুরোপুরি লোকসানে রুপ নেয় ফুল চাষ। হরতাল আর অবরোধের কারণে কৃষকসহ ব্যবসায়ীদের লোকসান গুনতে হচ্ছিল দিনের পর দিন।
ঝিনাইদহ সদর উপজেলার গান্না গ্রামের কৃষক নজরুল জোয়ারদার। তিনি এবার ৩০ শতক জমিতে ২০ হাজার টাকা লগ্নি করে গাঁদা ফুল লাগিয়েছিলেন। আশা ছিল লাভের মুখ দেখবেন। দফায়-দফায় হরতাল অবরোধের কারণে লোকসানে ছিলেন তিনি। ফুল পচনশীল হওয়ায়, পরবর্তী ফলন বাঁচাতে তিনি ও তার ছেলে দুজনে মিলে ফুল তুলে ফেলে দিতে বধ্য হয়েছিলেন। তিনি হতাশাই ভুগছিলেন। প্রান্তীক এই কৃষকের এবছর ফুলের ফলন ভালো হয়েছিল কিন্তু দেশের রাজনিতি তাকে হতাশাই ফেলে দিয়েছিল। তবে হঠাৎ করেই ৬দিনের ব্যবধানে তার পুরো দূরচিন্তা দূর হয়ে গেছে। ৬দিন আগে এক ঝুপা ফুল বিক্রয় করেছেন ৪০-৫০ টাকা সেই ফুল সপ্তাহ ঘুরতেই ২৫০ থেকে ৪৫০ টাকা পর্যন্ত বিক্রয় করছেন। এতে করে বিগত দিনের লোকসান কাটিয়ে উঠতে পারবেন বলে মনে করেন তিনি।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, সকালে ভোরের সূর্য ওঠার আগেই কৃষকেরা তাদের উৎপাদিত ফুল গান্না ফুল বাজারে নিয়ে আসছে। এক ঘন্টার ব্যবধানে সব ফুল বিক্রয় শেষ। এরপর ব্যবসায়ীরা সেগুলোকে প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ঢাকা চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পাঠানোর জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন। কৃষক ও স্থাণীয় ব্যবসায়ীদের থেকে জানাযায়, এক সপ্তাহ আগে যে গাঁদা ফুল বিক্রয় হয়েছিল ৪০-৫০ টাকা ঝুপা। সেই ফুলের দাম বৃদ্ধি পেয়ে বিক্রয় হচ্ছে ২৫০ থেকে ৪০০ টাকা ঝুপা। এভাবে অন্যান্য ফুলের দামও বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে সাধারণ কৃষক ও ব্যবসায়ীরা কিছুটা হলেও লোকসান কাটিয়ে উঠতে পারবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। কৃষকেরা বলছে, সনাতন ধর্মালম্বীদের দীর্ঘদিন পর লগ্নে বিবাহ বেড়েছে, এছাড়া বিজয় দিবস ও বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আমেজ শুরু হয়েছে। যার কারণে হঠাৎ করেই ফুলের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। এছাড়া নভেম্বরের শেষ দিকে হঠাৎ বৃষ্টির কারণে ক্ষেতেই বেশির ভাগ ফুল নষ্ট হয়ে যায়। যার ফলে উৎপাদনও কমে যায়। একদিকে ফুলের উৎপাদন কম অন্যদিকে বিজয় দিবসকে ঘিরে ফুলের চাহিদা বৃদ্ধি একারেণ ফুলের বাজার বৃদ্ধি পেয়েছে।

দেশের সবচেয়ে বড় গাঁদা ফুলের বাজার গান্না ফুল বাজার। গান্না ফুল ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক নজরুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি ফুল চাষী ও গান্না ফুল বাজারে ব্যবসায়ী করি। আগে ঢাকায় এক গাড়ী ফুল পৌছাতে খরচ হতো ১৮-২০ হাজার টাকা। সেখানে রাজনৈতিক অস্থিরতায় বর্তমানে ব্যবসায়ীদের গুনতে হচ্ছে ৩০-৩২ হাজার টাকা। তারপরও গাড়ী পাওয়া যাচ্ছে না। অবরোধের কারণে গাঁদা ফুল প্রতি ঝোপা (১০ চোইন) বিক্রি হয়েছে ৪০ থেকে ৫০ টাকা দরে। রিতিমত ধ্বস নেমেছিল ফুল ব্যবসায়। বিজয় দিবসকে ঘিরে ৬দিনে পুরো ফুল বাজারে আগুন। নিজেই ৬দিনে এক বিঘা জমি থেকে ১ লাখ ৫০ হাজার টাকার ফুল বিক্রয় করেছি। এখনো মাঠে ফুল রয়েছে। বিগত দিনে যে লোকসান হয়েছে তা পুশিয়ে উঠতে পারবো।
পাইকারি ফুল ব্যবসায়ী সোহাগ হোসেন জানান, শুধু কৃষকই না, অবরোধের কারণে লোকসানের সম্মুখীন হচ্ছে ফুল ব্যবসায়ীরাও। ১৬ই ডিসেম্বর ও সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বিয়ের লগ্ন চলায় ব্যবসা বেড়েছে। এতে করে ঝিনাইদহের আশপাশের জেলাসহ ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, সিলেটসহ বিভিন্ন জায়গাই ফুল যাচ্ছে। গান্না বাজার থেকে প্রতিদিন দেড় থেকে দুই কোটি টাকার ফুল ক্রয়-বিক্রয় হচ্ছে। তবে চাহিদার বিপরীতে যোগান কিছুটা কম।
ঝিনাইদহ গান্না বাজার ফুল ব্যবসায়ী সমাবায় সমিতির সভাপতি ও ফুল চাষী মোঃ জামির হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, একসপ্তহ আগেও দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা, দফায়-দফায় হরতাল অবরোধের কারণে ফুলের বাজার অনেক কম ছিল। আবার গাড়ি ভাড়াও বেশি ছিল। কৃষক এবং ব্যবসায়ীরা হতাশায় ভুগছিল। যেখানে গত একসপ্তাহ আগেও জারবারা ফুল বিক্রয় হয়েছিল ৮-১০টাকা, রজণীগন্ধা ৩-৪ টাকা, গোলাপ ৬-৭ টাকা গাঁদা প্রকার ভেদে ৪০, ৫০, ৮০ সর্বচ্চো ১০০ টাকা বিক্রয় হয়েছে। সেখানে বিজয় দিবস উপলক্ষে এবং হিন্দুদের বিয়ের লগ্ন আসায় ফুলের চাহিদা ব্যপক বৃদ্ধি পেয়েছে। গাড়ি ভাড়া বেশি হলেও বর্তমানে পাইকারী গাঁদা ফুল বিক্রয় হচ্ছে ৩০০ থেকে ৪৫০ টাকা ঝুপা, জারবারা ২০-২৫ টাকা, রজনীগন্ধা ৮-১০ টাকা, চন্দ্রমল্লিকা ৩-৪টাকা, গোলাপ ১৫ থেকে ২০ টাকা বিক্রয় হচ্ছে। যা গত সপ্তাহের চেয়ে কয়েকগুন বেশি।
তিনি আরো জানান, ঝিনাইদহের গান্না ফুল বাজার, বেলেডাঙ্গা ফুল বাজার, সামান্তা ফুল বাজারসহ জেলোর ৬টি ফুল বিক্রয় কেন্দ্র থেকে গত ৬দিনে প্রাই ২০ কোটি টাকার বেশি বিভিন্ন ধরনের ফুল বিক্রয় করেছে কৃষকেরা। এরমধ্যে বেশি বিক্রয় হয়েছে গাঁদা ফুল। জেলা থেকে উন্নত মানের যে গাঁদা ফুল, যা সারাদেশের ফুলের চাহিদা মিটিয়ে থাকে। ফুলের গুনগত মান ভালো থাকাই এই জেলা থেকে বছরে প্রাই ২শত কোটি টাকার ফুল বিক্রয় হয়। ঝিনাইদহ জেলাতে তালিকা ভূক্ত ফুল চাষী রয়েছে ৮ হাজারের বেশি। এর বাহিরেও প্রায় দুই হাজার ফুলচাষী তালিকার বাহিরে রয়েছে। বর্তমানে হরতাল অবরোধের কারণে ট্রাক ভাড়া পাওয়া খুবই কঠিন হয়ে পড়েছে। গাড়ির মালিকেরা গাড়ি ভাংচুর ও পোড়ানোর ভয়ে কেউ রাস্তায় বের হতে চাইছে না। সরকারের কাছে দাবী ফুলের গাড়িগুলো পুলিশের নজরদারিতে জেলা থেকে পাঠাতে পারলে কোন আতঙ্ক ছাড়াই নিরাপদে ফুলগুলো পৌছানো যেত।
ঝিনাইদহ কৃষি স¤প্রসারন অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আজগর আলী ঢাকা পোস্টকে জানান, জেলায় ২৫৪ হেক্টর জমিতে ফুলের আবাদ হয়েছে। ঝিনাইদহ সদর উপজেলা, কালীগঞ্চ, কোটচাঁদপুর, মহেশপুর ও হরিণাকুন্ডু উপজেলাতে বেশি ফুল চাষ হয়। বর্তমানে গাঁদা ফুলের চাষ সবথেকে বেশি। এর পাশাপাশি জারবেরা, চন্দ্রমল্লিকা, রজণীগন্ধা ও গোলাপের চাষও ব্যপক হারে বেড়েছে। এবছর ফুলের চাষও অনেক ভালো হয়েছে। হরতাল ও বৃষ্টির কারনে ফুল চাষীরা কিছুটা ক্ষতিগ্রস্থ হলেও বিজয় বিদবকে ঘিরে একসপ্তাহে যে বাজার পেয়েছে কৃষক, তা পূর্বের লোকসান কাটিয়ে উঠবে। এই জেলা থেকে আরো উন্নত ও মান-সম্মত ফুল চাষে কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে নিয়মিত কৃষকদের নানা পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *