স্বৈরশাসকের সন্তান হয়ে জন্ম নিলে ভাগ্যে কী ঘটতে পারে!
সম্প্রতি পিয়ংইয়ংয়ে অনুষ্ঠিত হয় দুটি বিশাল সামরিক প্যারেড। এই প্যারেড অনুষ্ঠানে সপরিবারে অংশগ্রহণ করেন উত্তর কোরিয়ার স্বৈরশাসক কিম জং উন। এ ঘটনা বেশ হইচই ফেলে দিয়েছে সারা বিশ্বে। উত্তর কোরিয়ার এই স্বৈরশাসক নিজের পরিবারের বিষয়ে বেশ রক্ষণশীল। বাইরের আলো থেকে পরিবারের সদস্যদের দূরে রাখতেই পছন্দ করেন তিনি। বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে তাকে সচারচর একাই অংশ নিতে দেখা যায়। কদাচিৎ পাশে থাকেন স্ত্রী রি সল জু। কিন্তু এই ধরাবাঁধা নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়ে এবারের সামরিক কুচকাওয়াজের অনুষ্ঠানে কিমের পাশে দেখা গেছে কন্যা কিম জু আয়েকে। ছড়িয়ে পড়া ঐ অনুষ্ঠানের ছবিতে দেখা যাচ্ছে, ব্যালিস্টিক মিসাইলের মধ্যরাতের কুচকাওয়াজ পর্যালোচনারত কিমের পাশে দাঁড়িয়ে আছে তার আনুমানিক ৯ বছরের কন্যা! কাকতালীয়ভাবে ছবিটির সঙ্গে প্রায় ১০০ বছর আগেকার একটি ছবির মিল খুঁজে পাওয়া যায়। কিমের মতো করেই বারান্দায় দাঁড়িয়ে মস্কোর একটি সামরিক কুচকাওয়াজ পর্যালোচনা করতে দেখা গিয়েছিল সোভিয়েত স্বৈরশাসক জোসেফ স্টালিনকে। ঐ অনুষ্ঠানে স্ট্যালিনের পাশেও দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায় তার কন্যা স্বেতলানা আলিলুয়েভাকে। কী অদ্ভুত মিল!
সত্যি বলতে আমি মনে করি, স্বৈরশাসকের কন্যাদের হতভাগাই বলতে হয়! স্বৈরশাসকের কন্যারা বাড়তি মনোযোগ আকর্ষণের দাবিও রাখেন বৈকি। কেননা, এদের ভবিষ্যৎ যেন অন্ধকারময় কানাগলি! স্টালিনকন্যা স্বেতলানার জীবনকালের নিরিখে প্রশ্ন তোলা যায়, কিম জু আয়ের ভবিষ্যতই-বা কী হতে চলেছে? স্বেতলানা আলিলুয়েভার জীবনী নিয়ে আমার লেখা ‘স্টালিনস ডটার’ বইয়ে আমি তার বহু স্মৃতিকথা তুলে ধরেছি। স্বেতলানার নিজের লেখা ‘অনলি ওয়ান ইয়ার’ থেকে বহু তথ্য পৃথিবীর সামনে হাজির করে আমি এটা দেখিয়েছি, একজন স্বৈরশাসকের সন্তানের প্রতিটি মুহূর্ত ঠিক কেমন হয়!
‘অনলি ওয়ান ইয়ার’-এ স্বেতলানা লিখেছেন, ‘আপনি স্ট্যালিনের কন্যা। এর অর্থ, আসলে জন্মের পরপরই আপনি মৃত! জন্মানোর সঙ্গে সঙ্গে আপনার জীবন শেষ! আপনি নিজের ইচ্ছেমতো জীবন যাপন করতে পারবেন না। আপনি কেমন জীবন কাটাতে চান, সে বিষয়ে আপনার মতামতকে একটুও আমলে নেওয়া হবে না। প্রতিটি জায়গায় সব ক্ষেত্রে আপনি কেবল স্বৈরশাসকের সন্তান তকমার সম্মুখীন হবেন।’
২০১৩ সালে মস্কোতে এক দীর্ঘ সফরে স্ট্যালিনের নাতি আলেকজান্ডার বার্ডনস্কির সাক্ষাত্কার নেওয়ার সুযোগ হয়েছিল আমার। তিনি আমাকে বহু বিষয়ে চমকে যাওয়ার মতো কথা বলেছিলেন। তার একটি কথা ছিল এরকম—সোভিয়েত সেনাবাহিনীর জীবন থেকে বের হয়ে যখন আমি নিজ বাড়িতে ফিরে আসি, সে সময় আমার মনে হয়েছিল ‘আমি মুক্তি পেয়েছি, দম ছেড়ে বেঁচেছি’। বলে রাখা দরকার, বার্ডনস্কিও তার ফুফু স্বেতলানার পথ অনুসরণ করেছিলেন। বংশপরিচয়ের তকমা থেকে রেহাই পেতে ফুফু স্বেতলানার মতো তিনিও মায়ের নামে পরিচিত হতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন। এমনকি তারা উভয়েই নিজেদের নামের সঙ্গে যুক্ত করেছিলেন মায়েদের নাম।
সাক্ষাৎকারে স্বেতলানা সম্পর্কে বার্ডনস্কি বলেন, ‘আমি তাকে একজন সাধারণ মহিলা হিসেবেই জানি। একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে তিনি আমার কাছে অত্যন্ত প্রশংসার পাত্র। সব আত্মীয়ের কথা বলতে পারব না। তবে ফুফু স্বেতলানা ছিলেন আমার কাছে অন্য কিছু—তিনি আমার ব্যাপক ভালোবাসার মানুষ।’ ফুফু স্বেতলানার প্রতি এই অতি ভালোবাসার কারণও ব্যাখ্যা করেছিলেন বার্ডনস্কি। তার ভাষায়—ফুফু স্বেতলানার প্রতি খুব টান ছিল দাদু স্ট্যালিনের। এর কারণ, ফুফুর বুদ্ধিমত্তা ছিল অত্যন্ত প্রখর। বিভিন্ন ক্ষেত্রে তার ইচ্ছাশক্তি ছিল অবিশ্বাস্য প্রবল।
বার্ডনস্কি বলতে থাকেন—শৈশবে ফুফু স্বেতলানা ছিলেন পিতা স্ট্যালিনের ‘প্রিয় কন্যা’। দাদু স্ট্যালিন ফুফুকে ছোট্ট সোনামণি, ছোট্ট ময়না পাখি, ছোট্ট চড়ুই পাখি ইত্যাদি বলে ডাকতেন। ফুফু দাদুর এতটাই আদরের ছিলেন যে, তিনি সব সময় পিতা স্ট্যালিনের বাহু জড়িয়ে ঘুরে বেড়াতেন। কন্যাকে দাদু যেন নিজের সেক্রেটারি মনে করতেন! কিন্তু দুঃখের বিষয়, সময় যতই গড়াতে থাকে, একটা পর্যায়ে গিয়ে সব ফিকে হয়ে যায়!